হিজলের সার্কিট হাউসে বসে শোনা।। আমিনুল ইসলাম
বিস্মিত আমি! আরে কোথায় পেলে তোমরা
আমার এমন নাম, এমন উপাধি?
যাক্, নামে তো কিছু যায় আসে না;
তারচেয়ে আমার কথা আমার কাছে শোনো!
আমি হাওড়, সমুদ্রের বংশধর;
বঙ্গোপসাগরের দূরসম্পর্কের নাতনি;
বংশলতিকা দেখতে চাও? দেখতে পারো।
তবে আগাম বলে রাখি, কূল পাবে না!
তোমরাও জানো, সমুদ্রের কাহিনি অশেষ;
সমুদ্রের বয়ফ্রেন্ড আকাশ, সেও শেষহীন নীলিমা;
তোমরা যারা আজ বেঁচে আছো উদ্ধত বর্তমানে,
এমন কত সচিত্র বর্তমান
জলছবি হয়ে লুকিয়ে রয়েছে-
সজল স্মৃতির অ্যালবামে!
সেই অ্যালবাম একটি কিংবা দুটি নয়,
অসংখ্য, অগণিত;
তোমরা কি পারবে সেসব খুলে দেখতে
যেভাবে গ্রাসবার্জ খনিশ্রমিকেরা চেম্বার খুলে খুলে
বের করে নিয়ে আসে সোনা, তামা
এবং আরও হরেক রকমের
অসংজ্ঞায়িত ধাতু-- কালো, ধূসর, পীতাভ, নীলাভ?
তোমাদের এই বিশ্বায়ন এইতো সেদিনের!
আর আমি সেই কবে থেকেই জন্মসূত্রে বিশ্বনাগরিক!
তথাপি দেরিতে হলেও আমাকে রামসার সাইট
ঘোষণা দিয়েছো, আমি খুশিই হয়েছি;
অবশ্য সেটা না হলেও আমার জন্মগত উজ্জ্বলতা
কমতো না এতটুকু।
হ্যাঁ, আমার বয়স হয়েছে; কিন্তু স্মৃতিশক্তি আজও অটুট;
আমার তো ডায়াবেটিস হয় না;
কারণ আমি দিতে জানি; এবং গ্রহণ করি খুবই কম;
আর বোশেখে পুড়িয়ে,-- ভাদরে ভিজিয়ে--
ঘুম দিয়ে কুয়াশার রাতে
প্রতিবছরই নবায়ন করে নিই নিজেকে।
আজ পেছন ফিরে তাকালে দেখি,
আমার বুকে নৌকা, বজরা, লঞ্চ—
এসব ভাসিয়ে এসেছে, গিয়েছে--
কতশত নাবিক
সওদাগর
এমনকি ডাকাতও;
হয়তো জানো, হয়তো-বা জানো না,
আমাকে দেখার পরই এক পরিযায়ী মহামানব
তোমাদের ভিটার নাম দিয়েছিল-
সিলিচাতুলা, সমুদ্রনগরী।
এবং এই তো সেদিনের কথা-- উনিশ শ একাত্তর সাল,
কত কিশোর-- কত যুবক,
কারো মাথায় বিদ্রোহী কবির ঝাঁকড়া চুল,
কারো মাথায় লাল গামছা,
নিদাঘের ঝাঁঝালো খরায়
হেমন্তের রহস্যজনক রাতের আঁধারে,
নাও নিয়ে যেতো আসতো ঘাটায়--আঘাটায়।
যাদের কথা এতক্ষণ বললাম, তারা সবাই
তোমাদেরই পূর্বজন কিন্তু তোমরা মনে
রাখতে পারোনি তাদের নাম-ধাম-পদবি;
কারণ মানুষের ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকে
পউষের হাওড়ের কুয়াশার মতন বিস্মৃতি;
আবার এটাও সত্য যে মানুষের স্মৃতির
মহাফেজখানা তো কুবেরের আটচালা;
তো কিভাবে রাখবে অতো মনে?
কেরামতি থাক্ বা না থাক্, মশাজান দিঘি তো
আর ধারণ করতে পারে না আধখানা সুরমা!
হ্যাঁ, আমি জানি, তোমরা একজনের কথা
মনে রেখেছ, তার নাম গর্ব করে বলো
এখানে ওখানে উৎসবে অনুষ্ঠানে,
আমার জলের আরশিতে এখনও ভাসে
তার গোলগাল মুখখানা;
তার ছিল-- সোনারঙ পিতলের হুকো,
সোনার পানের বাটা, লোহার সিন্ধুক,
চৈতালি চাঁদনিরাত এলে সে পানসি ভাসাতো
মায়াবী রুপালি জলে;
নাওয়ের ভেতরে সে কী রক্তের আনন্দ!
কী মাতাল উচ্ছলতা!
আমি শুধু পাহাড়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসতাম:
‘নেশা লাগিলো রে.. .. ..!’
সেই আনন্দ এমনই যে তোমরা আজ তা
আটলান্টিকে আর্কেডিয়া ভাসিয়েও পাবে না।
প্রবন্ধ,উত্তরাধুনিক কাব্যধারার যাত্রাঃ মতিন বৈরাগী-এখানে
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,নজরুলের রহস্য,পড়ুন এখানে
লিসেল মুলারের অনুদিত কবিতা পড়ুন এখানে
ভিন্ন স্বাদের গল্প,কফি হাউজের ওয়েটার' পড়ুন এখানে
বেড়েই চলেছে
বেড়েই চলেছে
বেড়েই চলেছে
এমনদিনে সহসা একদিন করচের ডালে বসা এক কানাবক
তার কানে কানে কি যে বললো,
বলা নেই, কওয়া নেই, সব ছেড়েছুড়ে
হঠাৎ সে হয়ে গেল জলের বাউল-
‘লোকে বলে- বলে রে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার!’
ঢেউয়ের আঁচল উড়িয়ে আমি জানিয়ে দিলাম
আমার সজল সমর্থন;
দিন গেছে; বছর গেছে; মোড় ঘোরানো
সেই উজান স্রোতেই নাও ভাসিয়েছে
রাধারমণ, শাহ করিম এবং আরও অনেকেই।
দ্যাখো--আমার এই পুরোনো উঠোনে আমি
সবাইকেই জলের পিঁড়ি পেতে বসতে দিই;
ভাইরাসমুক্ত হাওয়া দিয়ে জুড়িয়ে দিই
তাদের তপ্ত শরীর, পরিশ্রান্ত প্রাণ;
আমার যৌথ পরিবারে অগণিত সদস্য-
শকুন, গাঙচিল, কানাবক, সাপ, ব্যাঙ,
কচ্ছপ, টিকটিকি, গাং মাগুর, তারা বাইম
এবং আরও কত কে!
তাছাড়া ইবনে বতুতার মতো যারা আসে দূর থেকে,
প্রধানত শীতের মৌসুমে,
তাদেরও খেতে দিই চারবেলা,
ভিআইপি ভালোবাসায় থাকতে দিই আমার
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হিজলের সার্কিট হাউসে;
এবং আরও জেনে রাখো, আমার উঠোনে
কাউকেই বহিরাগত গণ্য করার গণতন্ত্র নেই;
তাই নেই কোনো এনআরসি।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব-- তোমাদের স্বঘোষিত
এই কথা শুনে শুনে হয়রান আমার যাদুকাটা কান;
অথচ এত ডাকাত-জলদস্যু,
এত হত্যাকারী-লুণ্ঠক,
এত বিভেদকামী অবিবেচক---
আমি অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে দেখিনি।
মোহাম্মদ জসিমের ভিন্ন রঙের কবিতা পড়ুন এখানে
জিল্লুর রহমান শুভ্র'র ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ুন এখানে
ওপার বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন বসুর কবিতা পড়ুন ক্লিক
ওপারের কবি তৈমুর খানের কবিতা পড়ুন এখানে
যারা জাল ফেলে
যারা বীজ বোনে
যারা কাস্তেহাতে কাটে
তাদের দিনের আলো রাতের জোছনা
বেগার খাটে গুটিকয় জলপ্রভুর আঙিনায়।
অথচ এত দেখেও অনেকেই শেখে নাকো,
যারা শেখে তাদেরও অনেকেই ভুলে যায়
সেরা হতে হলে জ্ঞান নয়,
বুদ্ধি নয়,
প্রযুক্তি প্রযোজিত প্রচারণা নয়,
চাই অন্যকিছু;
দ্যাখো, শয়তানের জ্ঞানের গভীরতা অনেক,
প্রভূত তার প্রতিভা,
তার সাফল্যও এত বেশি যে সেসব জড়ো করলে
উচ্চতায় ছাড়িয়ে যেতে পারে-
হিমালয় কেন, সিদরাতুল মুনতাহার ডগাও;
কিন্তু কেউই তাকে শ্রেষ্ঠ বলে না; কেন?
এসবের ভেদ জেনেছিলো আমারই এক সুযোগ্য সন্তান,
একতারা হাতে সেকথাই শুনিয়ে গেছে সে-
‘বসন্ত বাতাসে-- সই গো বসন্ত বাতাসে,
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’
তোমরা কি এখনও শোনো তার মহামিলনের গান?
তাহলে কেন রচো প্রেমবৈরী কাঁটার দেওয়াল!
তোমরা কি চাও না যে--
পড়শিবাড়ির প্রেমের ঘ্রাণ এসে ভরে তুলুক
তোমার সবখানি আঙিনা এবং
তোমার ভাটিয়ালি সুর জলছত্র রচুক
তার সুতপ্ত হৃদয়ে?
আমার তো জড়াজড়ি ঐক্যের জীবন;
তাকে কেন ভাগ করো?
দ্যাখো, মেঘ-মেঘ জননী তিরিশটি স্তন দিয়ে
বাঁচিয়ে রেখেছে তার জলসংসারী জলকন্যাকে;
তাকে পর করো যদি সেই স্তন থেকে,
হে মানুষ, তোমরা বিশ্বাসঘাতক,
এভাবেই প্রকৃতির খাতায়
লেখা হবে তোমাদের নাম বিদ্রোহী জলের বর্ণমালায়।
আচ্ছা, তোমরা কি সত্যি সত্যি মহত্ত্বের সিংহাসনে
বসতে চাও? যদি তাই হয়,
হৃদয়ে ধারণ করো আকাশের অবিভক্তি;
তোমাদের মধ্য থেকে একজনই পেরেছিল তা,
তাকে মোগলে আজম বলে আজও কুর্নিশ করে
বিতর্কের কালো দেয়ালে
ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুধসাদা ইতিহাস।
আর ওই যে আমার শরীরঘেঁষা মেঘের বাড়ি,
সেখানে বসেই তোমাদের এক কবি রচেছিলেন
কবিতা নামের ভালোবাসার উপন্যাস।
নীল নীলাদ্রি চোখ মেলে দেখেছি আমি আরও কত কি!
পূর্ণিমার রাতে চাঁদ তার চাঁদমুখ দেখে
প্রণয়ী জলের ড্রেসিং টেবিলে
সেই দৃশ্য দেখো যদি একবার, আমার বিশ্বাস,
ভুলবে না কোনোদিনও,
নুরজাহানকে সাথে পেয়েও আমৃত্যু যেমনটি
ভুলেনিকো শাহজাদা সেলিম
চাঁদনিরাতে চারবাগে চুরি করে দেখা আনারকলির মুখ।
কিন্তু চোর চায় রাহুগ্রস্ত চাদ;
তোমরাও কেউ কেউ কালি মাখাও তোমাদেরই
উজ্জ্বল ইতিহাসের মুখে; দেখে আমি কষ্ট পাই;
কষ্ট পায় ত্রিকালদর্শী আকাশ,
কষ্ট পায় যাবতীয় জীবনের মহাজননী সমুদ্র্র।
তোমরা যারা আমার আঙিনায় থাকো
হাজারে হাজারে,
পরিযায়ী ডানায় যারা আসো দূরদূরান্ত থেকে
শীতে ও বর্ষায়,
তারা তো নিজচোখেই দেখেছো--
কারও জন্যই আমি রচে রাখিনি
কাঁটাতারের বেড়া,
আমার হাতে কখনও ওঠেনি বারুদের নল।
আরেকটি কথা-- আমি কোনো ভুয়া খাজাবাবা নই,
আমার সচ্ছল সংসার থেকে সত্যি সত্যি
কাউকে ফিরাই না আমি শূন্যহাতে;
কেউ নেয় মুঠোভরতি একমুঠো শান্তি,
কেউ নেয় ক্যামেরাভরতি চোখজুড়ানো সুখ,
কেউ নেয় কানে ভাদরের ভাসমান সুর,
কেউ কেউ শ্রাবণ-ঢেউয়ের মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ছেনে
জীবনের অন্ত্যমিল পুরে নিয়ে যায়
ছন্দহীন প্রাণের পকেটে,
কেউবা আবার সাদিকের মতো
মুগ্ধহাতে কুড়িয়ে নেয় কবিতার সুরগর্ভ চিত্রকল্প:
“হাওড় যেখানে সিথান রেখেছে
পাহাড়ের কোলে এসে
মরমি মানুষ উড়িয়েছে পাল
দেহ-বজরায় ভেসে।”
আর যারা কিছুই পারে না নিতে নিজহাতে,
আর কিছু না হউক,
অন্তত ফুসফুস ভরতি বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিয়ে
বিদায় জানাই তাদের আর বলি:
নিজেদের সৃষ্ট দূষণের মুখে স্কচ টেপ মরে
ভালো থেকো তোমরা!
আর সময় পেলে আবার এসো বেয়ার্স পোচার্ডের ডানায়!
ফিবছর জলের উঠোনে জমে ওঠে
পাখপাখালির খেলার মাঠ;
ঘরেরই শতশত পাখি;
রিটার্ন টিকেট নিয়ে কত পাখি উড়ে আসে
শীতের মৌসুমে!
কোনোকিছুই নিয়ে তারা হয়ে ওঠে না
ভারত-পাকিস্তান;
সাইবেরিয়ান হাঁস আসে; ঠোঁট ঘষে তাকে
স্বাগত জানায় ধর্মপাশার পানকৌড়ি;
তার বিদায়কালে কোমলহৃদয় ডাহুক
ঠাণ্ডাজলে উষ্ণজল মিশিয়ে গায়:
‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি..!’
হাজার বছর ধরে উন্মুক্ত উঠোনে, প্রতি পৌষে
অগণন দর্শকশ্রোতার উপস্থিতিতে
আয়োজিত হয়ে আসছে পাখপাখালির Olox উৎসব;
প্রকৃতির ইউটিউবে তারাই
জরিনা কপিরিনা-এন্ড্রুজ ভেরান্যান উরুমিদিস ;
আর হাসনের বাউল বজরায়,
রাধারমণের বিচ্ছেদী উঠোনে,
শাহ করিমের প্রণয়ী একতারায়
এই উৎসবেরই সুর বেজে উঠেছে বারবার।
দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই থাকো,
মনে রেখো,
ভালোবাসা চিরকাল হলুদিয়া পাখি
ভালোবাসে হিজল উষ্ণতা
হিম জমলে হৃদয়ে উড়ে যায় দূরে;
মনে হলে ফিরে আসে; মনে হলে আসে নাকো;
কখনো-বা লুব্ধ দুপুরে ধরা পড়ে
সাদা বোকা বগার ডানায়;
তারপর কোনো এক সাঁঝে উড়ে যায়
ফেলে রেখে ছিন্নভিন্ন ফাঁদ!
এইসব জেনে রাখা ভালো,
তবু তাকে খাঁচায় পুরো না,
কাটতে যেও না তার গ+৩৭০ ডানা;
পারো যদি সলিম আলী হও
Nikon DSLR হাতে ছুটে চলো পিছু পিছু;
অথবা নিজের হৃদয়ে বানিয়ে রাখো
কোনো মাতৃসচ্ছল উন্মক্ত হাওর
ডানা মেলে উড়ে এসে বসবে সে প্রেমপাখি
জলমাখা হিজলের ডালে;
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিকের মনে
বুকের বোতাম খুলে ডেকে নেবে
করচের শাখা;
বসে থেকে ক্লান্ত হলে উড়ে যাবে
মেঘালয়ে মেঘের মিনারে;
আসবে যাবে- যাবে আসবে
পর্দাহীন চোখ মেলে চেয়ে চেয়ে দেখবে তা
বারুদের নলহাতে মিলনবৈরী কাঁটার প্রাচীর।
আর উত্তরাধুনিক নিষেধের খোয়াড় থেকে
বের হয়ে এসে
বিবাহিত রাতে-
চুপি চুপি তুমি লিখবে
প্রেমের কবিতা-
কখনো বিমুগ্ধ বেদনার চক্রবাক
কখনোবা সদগ্ধ মুগ্ধতার বনলতা সেন!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks