লিসেল মুলারের কবিতা ভূমিকা ও অনুবাদ: তূয়া নূর–কুয়াশা–translated by tuwa noor



লিসেল মুলারের কবিতা
ভূমিকা ও অনুবাদ: তূয়া নূর

কবি ও অনুবাদক লিসেল মুলারের জন্ম ১৯২৪ সালে জার্মানির হামবুর্গে। নাৎসি নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য ১৫ বছর বয়সে বাবা ও মায়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হন।লিসেল মিলার ইভান্সভিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে কবিতা লেখা শুরু করেন মায়ের মৃত্যুর পর।

লিসেল মুলার তার আত্মদর্শনমূলক, সহজবোধ্য কবিতার জন্য বিখ্যাত। তার কবিতায় আছে জীবনের ঘটনা ও  নিগুঢ় সত্য কথার সরল ও সাবলীল বর্ণনা। পরিবার, স্মৃতি, প্রকৃতি এবং অভিবাসী অভিজ্ঞতা সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় ব্যক্তিগত জীবন ও অভিজ্ঞতার কথা সার্বজনীন হয়ে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছে। মুলারের কবিতায় একটা কথোপকথনমূলক সুর আছে যেখানে একটি সূক্ষ্ম কল্পনাপ্রবণ শৈলীর ছাপ আছে। মুলারের কাব্যগ্রন্থ ‘অ্যালাইভ টুগেদারশ নিউ অ্যান্ড সিলেক্টেড পোয়েমস’ পেয়েছে পুলিৎজার পুরস্কার। ‘দ্য নিড টু হোল্ড স্টিল’ পেয়েছে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড। চবেশ কয়েকটি অনুবাদ খণ্ডও প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে মেরি লুইস কাশনিৎজের লেখা ‘সার্স'স মাউন্টেন’।লিসেল মুলার মারা যান ২০২০ সালে ইলিনয়ের লেক ফরেস্টে। 


ঘুমপাড়ানি গল্প

এক ফোটা তেলের মতো ভেসে আছে চাঁদ
নদীটার বুকে।
শিশুরা আসে এই নদীর পাড়ে
কাটা ঘা ও ক্ষত ধূয়ে মুছে ফেলতে। 
বাবারা আসে, যারা দেয় কাটা দাগ ও ক্ষত,
নেভাতে তাদের বুকের হুতাশন।
মায়েরা হয় বড় ভালবাসাময়, মুখে কোমলতা,
ডাক দিয়ে পাখি বুঝিয়ে দেয় জেগে আছে তারা;
হাতে হাত ধরে তারা সবাই দাঁড়ায়ে,
আর গাছপালা গুলো তাদের চারপাশে,
অনন্তের অপেক্ষা দিকচক্রবালে 
তাদের একজন হয়ে ওঠা।
কাঁপুনি থামাও, উচ্চারিত হোক তাদের প্রথম শব্দ।
কিন্তু এটা গল্পের শুরু নয়।
এটা গল্পের শেষ।
আর সব সর্বনাশ হবার আগে 
এই মা, বাবা ও সন্তানদের
খুঁজে বের করে নিতে হবে পথ নদীর কাছে যাবার,
আলাদা আলাদা করে, যেখানে পথ দেখানোর কেউ নেই,
মনে হবে এ এক দীর্ঘ, ভীষণ নির্মম কিছু
যা তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। 


রক্ত কমলা

আমি তখন এক শিশু হিটলারের জার্মানিতে 
উনিশশ ছত্রিশ সাল,
স্পেনের যুদ্ধ নিয়ে আমার কতোটুকুইবা ধারণা থাকতে পারে?
আন্দালুশিয়ায় ছিল ট্যাঙ্গো নৃত্য
বেজে ওঠা হাতে ঘুরানো গ্রামোফোনের সাথে,
সংবাদপত্রে ফ্রাঙ্কো একজন নায়কের মুখ। 
কেউ আমাকে বলেনি একজন কবির কথা,
যার জন্য আমার স্প্যানিশ ভাষা শেখা। 
রক্ত ঝরে মৃত্যু হলো যার একটা বিরান পাহাড়ে। 
স্পেন বলতে বুঝতাম একটা দেশ যেখান থেকে  
আমদানি করে আনা হতো অতীব মূল্যবান মিষ্টি খাবার,
আমরা দেদারসে খরচ করতাম ক্রিসমাসের সময়। 
আমার মনে আছে টেনে অংশ গুলো আলাদা করতাম 
তারপর সাজিয়ে রাখতাম লম্বা করে, চুষে খেতাম একেকটা রয়ে সয়ে
যেন লাল মিষ্টি থেকে যায় অনেক দিন—
একটা কবিতা পড়েছিলাম অনেক আগে লেখা মৃত এক জার্মান কবির যেখানে লেখা 
একটা বনাঞ্চল চাঁদের দুধ রং চোখের নীচে দাঁড়ায়ে
আর সাদা কুয়াশা সেই তৃণভূমিতে বাসনা করে 
বাতাসের চেয়ে হালকা হবার। 
---

চাঁদ ধরা

ভরা চাঁদের রাতে তারা ক’জন এলো জলের ধারে
কেউ কাঁটাচামচ, কেউ নিড়ানি, কেউ চালুনি ও  হাতা নিয়ে,
আর একজন এলো রূপার পেয়ালা নিয়ে।
তারা চাঁদটাকে ধরতে থাকে  
যতক্ষণ না একজন পথচারী তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, 
বোকার হদ্দরা, 
চাঁদ ধরতে গেলে তোমাদের রমণীদের চুল জলের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে—
এমনকি ছলনাময়ী চাঁদও ঝিকিমিকি সুতোর জালে লাফিয়ে পড়বে ঝটপট করে,
দম আটকে মুখ থুবড়ে
রূপালী আঁশ কালো হয়ে সে পড়বে স্থির হয়ে পায়ের কাছে। 
এরপর তারা কথামতো তাদের রমণীদের চুল বিছায়ে মাছ ধরতে থাকে 
যতক্ষণ না একজন পথচারী তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল,
বোকার হদ্দরা, 
তোমরা কি মনে করো চাঁদ এতো সহজে ধরা পড়ে,
চকচকে আর রেশমি সুতোয়?
তোমাদের হৃদয় কেটে বড়শিতে অবশ্যই টোপ গেঁথে দিতে হবে—
কালো প্রাণীদের সাথে;
এটা কোন ব্যাপার বিলায়ে দাও যদি হৃদয় 
যখন ভাসবে তোমাদের স্বপ্নে? 
এরপর তারা তাদের আঁটসাঁট, উষ্ণ হৃদয় দিয়ে মাছ ধরতে থাকে 
যতক্ষণ না একজন পথচারী পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, 
বোকার হদ্দরা,
একজন হৃদয়হীন মানুষের কাছে চাঁদের কী মূল্য?

যথাস্থানে রেখে তোমাদের হৃদয়টা হাঁটু গেড়ে বসো
আর এমন ভাবে পান করো যেমনটা কখনও করো নি,
যতক্ষণ না তোমাদের গলাগুলো রূপায় মুড়ে যায় 
আর তোমাদের কণ্ঠস্বর ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে। 

চাঁদ ধরতে থাকে তারা ঠোঁট আর জিভ দিয়ে  
যতক্ষণ না জল শেষ হয়ে গেল 
আর চাঁদ তখন ফসকে গিয়ে হারালো নরম, অতল কাদার ভেতর। 



জিনিস

ব্যাপারটা ঘটে এরকম,
আমরা একা হয়ে পড়ি
অনেক জিনিসের ভেতর বসবাস করতে করতে,
আমরা ঘড়ির একটা মুখ বানিয়ে দেই,
চেয়ারকে দেই একটা পিঠ,
টেবিলকে দেই চারটে শক্ত পা
আড়ষ্টতায় যেন কখনো না ভোগে ।

আমরা আমাদের জুতাতে জিহ্বা লাগিয়েছিলাম
আমাদের নিজের মতোই মসৃণ
আর ঘণ্টাতে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম জিহ্বা
যেন আমরা তাদের আবেগ ঘন ভাষা শুনতে পারি,

আমরা সুন্দর আবয়ব পছন্দ করি বলে
কলস পেলো একটা ঠোঁট,
বোতল পেলো একটা লম্বা, সরু ঘাড়।

আমাদের বাইরে যা ছিল তাও
আমাদের ছবিতে পুনর্নির্মিত হয়েছিল;
আমরা দেশকে একটি হৃদয়,
ঝড়কে একটা চোখ,
গুহাকে একটি মুখ দিয়েছিলাম
যাতে আমরা নিরাপদে ঢুকে যেতে পারি।



লবণের মত ভালবাসা

আমাদের হাতের উপর রাখা দানা গুলো
খুব জটিল তার মর্ম উদ্ধার করা

তেমন কোন চিন্তা না করেই 
ছিটিয়ে দেই রান্নার কড়াইয়ে

 খুব মিহি হয়ে ছিটকে পড়ে মেঝেতে
 তার উপর দিয়ে সমস্তটাই আমরা হেঁটে যাই

আমরা চোখের গোলকের পিছনে এক চিমটা ধারণ করি
সে আমাদের কপাল দিয়ে বেয়ে পড়ে

আমরা তাকে জমা করে রাখি শরীরের নিভৃতে 
এক গোপন চামড়ার ভিস্তিতে। 

রাতে খাবারের টেবিলের চারপাশে বসে আমরা 
এটা এর কাছ থেকে ওর কাছে ঠেলে দিতে দিতে 
ছুটির দিন ও সমুদ্র নিয়ে কথা বলি।  


--

with thanks & regards____

image

দ্বীপ সরকার

editor of kuasha

+88001719751792

kuasha.mag@gamil.com

https://mkuasha.blogspot.com/

facebook

twitter

linkedin



Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন