গল্প।। একজন কফি-হাউসের ওয়েটার।। নোমান আব্দুল্লাহ্।।story by noman abdullah.kuasha

গল্প




একজন কফি-হাউসের ওয়েটার
নোমান আব্দুল্লাহ্

ধোঁয়া উঠছে কফির কাপে, ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে জানলার বাইরে রোদঝলমল দুপুরে। ধোঁয়া যেন মানুষের নিঃশ্বাসের রূপ, ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কত বছর হলো এই কাপের ধোঁয়া দেখতে দেখতে চলে গেলো? মনে হয়, এই ধোঁয়ার ভেতরেই আমি মানুষ চিনেছি, জীবন চিনেছি। টেবিলের কাঠে খোদাই করা নাম, চেয়ারের ছেঁড়া কাপড়, জানলার কাঁচে জমে থাকা ধুলোর আস্তর—সবকিছুই অন্তহীন গল্প বলে চলে।

তবু কেউ গল্প বলতে আসে না। তারা শুধু বসে, একেকজন একেকভাবে। আর আমি শুধু শুনি। শুনি না আসলে, গল্পগুলো নিজেরাই এসে টুপ করে বসে যায় আমার মগজে। ঢুকে যায়, জায়গা করে নেয়। কফির কাপ ধরা হাত কাঁপলে বুঝি ভেতরে ঝড় চলছে। খালি চোখে না দেখলেও বোঝা যায় শহরের প্রতিটি মানুষই যেন একেকটা অনুলিখিত কবিতা।


সকালের দিকে যে ছেলেটি আসে—কখনো তার মুখে আলো, কখনো ক্লান্তির রেখা। খাতায় আঁকিবুঁকি করে, কিছু লিখে আবার কেটে দেয়। অক্লান্ত সব মনোলগ, কিন্তু আমি শুনি—তার খাতার পাতাগুলো চিৎকার করছে: "আমাকে শুনো, আমি তোমাদের গান হতে চাই!"
কফির ফেনায় তার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে—একটা অর্ধেক সুর, অর্ধেক স্বপ্ন।
আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই লাইন—"অসীমের সুরে বাঁধা রইল না প্রাণ।"
সে জানে না, তার অল্প ভিউ-এর ভিডিওই একদিন হয়তো কারও জীবন পাল্টে দেবে। যে ছেলে এখনো ভাড়া মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তার কণ্ঠস্বর হয়তো একদিন হাজারো মানুষের কাছে মুক্তির ডাক হয়ে উঠবে।


দুপুর গড়িয়ে এলে, সেই পরিচিত টেবিলে বসে যায় দু’জন। কণ্ঠস্বর ওঠানামা করে ঢেউয়ের মতো। "তুমি বুঝো না", "তুমি তো কোনোদিন শোনো না"—এই শব্দগুলোই তাদের প্রেমের মন্ত্র।
আমি দেখি, রুবিনার চোখ লাল হয়ে উঠছে। কামরুল চুপ করে জানলার বাইরে তাকায়। যে মানুষটা স্ত্রীকে সময় দিতে পারে না, সে-ই আবার সময় কিনতে চায়, অধিকর্ম করে।
তাদের কথার মধ্যে বাজে—ঝগড়া, জমাট, জেদ।
তবু শেষে আসে জমাটবাঁধা জড়ানো হাত।
তাদের ভালোবাসা আসলে নদীর মতো—পাড় ভাঙে, তবু বয়ে চলে।


বিকেলের আলো ঢলে পড়লে যে বুড়ো আসেন—তার পদক্ষেপ যেন দীর্ঘঃশ্বাসের মতো। তিনি কথা বলেন না, কফির ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে ওঠে অপরিচিত নারীর মুখ। সেই মুখ আমিও দেখি, যদিও আমার চোখে তা শুধু একটি খালি চেয়ার।
তার প্রতিদিনের যাতায়াত আসলে মৃত্যুর সাথে আলাপচারিতা। তিনি এখানে আসেন, কারণ এখানে মৃত্যু নেই; আছে স্মৃতি।
কফির কাপটা ঠোঁটে তোলার সময় তার আঙুল কেঁপে ওঠে। মনে হয়, তিনি কাপের ভেতর থেকে স্ত্রীর হাসি শুনতে পান।
একদিন হঠাৎ আমার মনে হলো—এই মানুষটি না থাকলে এই টেবিলটিও বোধহয় ভেঙে যেতো।


রাত ঘনিয়ে এলে আসে ওরা দু’জন তরুণ মুখ। টেবিলের কোণে বসে শব্দগুলো লুকিয়ে ফেলে, যেন শব্দেরও চোখ আছে। তাদের হাসি ছোট, কিন্তু চোখের আলো বড়।
শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট। পার্থক্য শুধু, ওরা মরতে চায় না, বাঁচতে চায় একসঙ্গে।
যে সমাজ প্রেমকে স্বাভাবিক বলতে শেখায়, সেই সমাজেরই চার দেয়ালের মধ্যে ওরা ফিসফিস করে কথা বলে।
আমি কানে আঙুল দিই না, তবু সব শুনি। শুনি, কারণ কথাগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কমনীয় সত্য।


কখনো তিনজন বসত ওখানে। একসময় হেসে গড়াগড়ি খেত, এখন বসে একা একা। কারও মুখে অভিমান, কারও কণ্ঠে ক্লান্তি।
তাদের টেবিল এখন এক প্রকার শোকগাথা। একটি মৃত বন্ধুত্বের কবিতা।
আমি ভাবি, ব্যবসা কেন এমন শত্রু হয়ে যায়?
বন্ধুত্বের ভাঙা কাঁচ কফির টেবিলে ঝরে পড়ে, আর আমি কেবল তা ঝাড়ু দিই। আমি ঝাড়ু দিয়ে সরাই, ভেতরে বাজে অসংখ্য কাঁচভাঙা শব্দ।


শহরটা কি আলাদা? না, শহর এমনই। সবাই ভিড়ে মিশে আছে, তবু একা। এখানে প্রতি কাপ কফি যেন একেকটা নীরব স্বীকারোক্তি। কেউ উচ্চারণ করে, কেউ লুকিয়ে রাখে।
টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা রোদ যেন ভাঙা আয়না। তাতে প্রতিটি মুখে প্রতিটি গল্প আলাদা করে ঝলসে ওঠে।
আর বাজে—"ভালোবাসা ভাঙে, ভয় ভাসে, ভিতর ভিজে যায়।"


হ্যাঁ, আমি ওয়েটার। নামে কার কি এসে যায়? নামগুলো তো আমার কাছে কেবল ছদ্মবেশ। আমি যাদের দেখি, তারা নামহীন হয়েও আমার কাছে চিরকালীন।
আমার নিজের গল্প কেউ শোনে না। আমি শোনাইও না। আমার হাতে শুধু ট্রে, কিন্তু ট্রেটাই আমার ক্যানভাস। সেখানে ঝরে পড়ে মানুষের অশ্রু, সেখানে জমে ওঠে মানুষের হাসি।
কফির ধোঁয়া একদিন আমার শরীরকেও আচ্ছন্ন করবে। আমি থাকব না, কিন্তু এই কাঠের টেবিল থাকবে, এই ধোঁয়া থাকবে, এই গল্পগুলো থাকবে। হয়তো কোনো নতুন ওয়েটার এসে আমার জায়গায় দাঁড়াবে, আবারও শুনবে ঝগড়া, প্রেম, নিঃসঙ্গতা অথবা বন্ধুত্বের ভাঙন।
এই ক্যাফে আসলে জীবনের প্রতিরূপ। এখানে সবাই আসে, কিছুক্ষণ বসে, তারপর চলে যায়। কেউ ফেরে, কেউ আর ফেরে না। কিন্তু টেবিল, চেয়ার, আর কফির ধোঁয়া থেকে যায়।
ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে জানলার বাইরে।
শহর ঘুমোয় না, আর আমি?
সবশেষে বুঝি—আমি কফি-হাউসের ওয়েটার নই, এই শহরের অদৃশ্য শ্রবক।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন