রবীন বসু
প্রচ্ছন্ন ঘুমের দেশ
আমি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি
কখন যে পথে এলাম, ঠিক মনে করতে পাচ্ছি না;
অথচ ধুলোমেখে, ধুলোখেয়ে আমি হাঁটছি গন্তব্যে—
গন্তব্য কিছু আছে? নাকি শুধুই উদ্দেশ্যহীন হাঁটা
দূরত্বের মধ্যে আরও দূরত্ব অতিক্রম করি, আরও—
দু’পাশে ঝাপসা বাড়িঘর, প্রাচীন বৃক্ষ আর গম্বুজ
আমি কি গম্বুজ ছুঁয়ে দেখতে পারি! স্পর্শময় ভুল!
তাহলে পুনরায় ত্রুটিহীন কারুকার্যের নির্মাণ
চেষ্টা করে দেখা যেত! সুসজ্জিত তোরণ
বন্ধুদের বাড়ি ছাড়িয়ে, শত্রুদের বাড়ি এড়িয়ে
মাঠে নেমে পড়লুম। জলের গন্ধ, ঘাসের গন্ধ
শৈশব ও যৌবনের কত যে ভাল আর মন্দ গন্ধ
আমার নাক টেনে নিল; আমি সুখানুভূতির সঙ্গে
এক রকম বিচ্ছেদ-সাঁকো মাড়িয়ে, খাল পার হয়ে
ধূ-ধূ প্রান্তরে এসে দাঁড়াই। নিরালম্ব অবকাশ—
নিঃসীম অন্ধকারে রাত্রি জেগে আছে, চাঁদ তারা
ঘাসের অভ্যন্তরে পোকা-ব্যাঙ-ফড়িং—
তাদের নিঃশ্বাস আমার কানে আসে
আমি শুয়ে পড়ি মাঠের আলে
আদিম শীতলতায় আচ্ছন্ন সরীসৃপ হয়ে যাই!
তারপর, বেঁচে থাকার প্রচ্ছন্ন ঘুমের দেশে সন্তরণ
সব ভুলে যাই, সব ভুলে যাই ক্রমশ…
ক্ষুধার্ত প্রেমিক-হাত
তোমার দক্ষিণ হস্ত সংসারের থালা ধরে থাকে
বাম হস্তে আমি থাকি সংগোপন আঁচলে লুকিয়ে।
বৃষ্টির ভিতর এই সব কথা হচ্ছিল অস্পষ্ট
গত জন্মের কুয়াশা ভাসিয়েছে মাঠ ঘাট পথ—
তোমার মুখের লিপি অতিদ্রুত পালটে যাচ্ছে
তবু সবুজ ঘাসের মাথায় ফড়িংয়েরা লাফায়,
তুমি বাচ্চাদের ভাত বেড়ে দাও, মাছ ঝোল দাও
আমি অভুক্ত সংশয় নিয়ে দুয়ারে দাঁড়াই নিত্য।
সংসার সামলে তুমি বল, অপেক্ষা কর, দাঁড়াও
তারও পর হাত খালি হলে, আঁচলে হাত মুছতেই
আমার স্পর্শ তোমার হাতে; শিহরণ খেলে গেল—
বোকার মতো দাঁড়িয়ে, তুমি চলে গেলে ত্রস্ত পায়ে।
তোমার দক্ষিণ হস্ত ছুটে গেল সংসার আগলাতে
আর বাম হস্ত ছেড়ে দিল ক্ষুধার্ত প্রেমিক-হাত!
প্রাগৈতিহাসিক ভ্রম
নির্দিষ্ট উৎসের দিকে ফিরে যাওয়া আগ্রহ
তবু সম্ভব হচ্ছে না, এতটা দূরত্বে এসে যেন
পুনরায় স্মৃতিচিহ্ন ধরে হাঁটা মুর্খামিই হবে!
নিশিজল ঝরে পড়ে, ঞআবহমান অস্থির বটে
জিজ্ঞাসাবাহিত এই আমাদের জীবন ছুটল
কোথাও গোপন ইচ্ছা, অপ্রকট সত্য ঢাকা আছে
ধনুকে ছিলার টান, বর্তমান মোহময় ফাঁদ
সেখানে শিকার ঝোলে স্বপ্নভঙ্গ মর্মান্তিক ছবি;
দৃশ্য থেকে সরে যায় একান্ত অবলোকন ভার
স্পর্শে নেই শরীর ও দৃশ্যকল্প বরাবর মুখ
হারিয়ে ফেলেছে সব প্রাগৈতিহাসিক ভ্রম
ভ্রূণের মধ্যেও জেগে ওঠে আশ্বাস জীবনের!
নির্দিষ্ট উৎসের দিকে ফিরে যেতে গিয়েও থমকে
এই যে বর্তমান তাকে আলিঙ্গনে ধরে রাখা ভাল।
মিহিজাম সুতো
তোমাকে বিদ্যুৎ ভেবে কাঠ তুলে নিই হাতে
আত্মরক্ষা আর মৃত্যু সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়
নিজস্ব ভূগোলে থিতু এ-পারস্পরিক বাঁচা
হয়তো নির্ণায়িত সত্য, তবুও রিখটার স্কেলে
যে কম্পন নির্ধারিত সহ্যসীমা অতিক্রম করে
ধ্বংস ও প্রতিধ্বংসের শিলালিপি লিখে রাখে
তাকে প্রাগৈতিহাসিক হিংসা দিয়ে সাজানোর
মূর্খামি যথার্থ নয়, আলোকিত অন্ধকার বলে
কোনও এক প্রহেলিকা ঘিরে ধরে আমাদের
হাবুডুবু খেয়ে যাই, আতান্তর শেষ হলে
বিকেলের মরারোদ মিহিজাম সুতোয় ঝোলে!
ইমদাদুল হক মিলনের নুরজাহান উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধঃ পড়ুন
চানক্য বাড়ৈ এর কবিতা পড়ুন এই লিংক এ
আহরিত পাপ
হাতের মধ্যে হাত, তবু স্পর্শ নেই কেন?
হৃদয়ে হৃদয় উত্তাপহীন পড়ে আছে
বিপরীত হাঁটা মেরু বরাবর….
সমস্ত নৈকট্যের পাশে দূরত্ব ব্যবধান
সম্পর্ক বিচ্ছেদ চায়
নিরাসক্ত হিম জমে মৃদুমন্দ ঘাসে…
মুণ্ডহীন কবন্ধ শরীর নাচে বিভঙ্গ মুদ্রায়
রক্তের ফিনকি নেই কালশিটে দাগ
সময় হাঁটু ভাঙে তার যত আহরিত পাপ…
বিনাশের শেষ চিহ্ন ঝুলে আছে গাছে
প্রাগৈতিহাসিক হিংসা নিয়ে সভ্যতা হাঁটছে
সময় তাকিয়ে আছে দিশাহীন দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে…
আনন্দব্রীড়া
হৃদয়ে ব্যাকুল তাপ, উত্তেজিত শিরাউপশিরা
লোহিত কণিকা যেন নৃত্য করে উদ্দাম উৎসুক
শরীর উন্মুখ হয়, আকাঙ্ক্ষা দরজা খুলে দিল
ত্রিলোক নির্বাক চেয়ে, এইবার ভূমিকম্প শুরু
নিমগ্ন সুস্থির প্লেট সরে গিয়ে লন্ডভন্ড হবে
সুনামি অস্থির হলে প্লাবনে ভাসায় চারদিক
ভেসে যাই প্রেমজ্বরে আলুথালু নিশ্চিত পতন
নিমজ্জিত হাহাকার আর যত হৃদয়ের আর্তি
শরীর বিভঙ্গে খোঁজে সম্মোহিত আহ্লাদিত সুখ
জীবন দুর্বার হাঁটে খানাখন্দ উঁচুনিচু পথ
নিজস্ব প্রেমের জ্বরে কাবু হয়, খাবি খেযে তবু
উঠে হাঁটে উলুঝুলু বাউল-একতারা সম্বল
হৃদয়ে সঞ্চিত তাপ উত্তেজিত শিরাউপশিরা
স্খলনে প্রবল সুখ বেঁচে থাকে আনন্দব্রীড়া!
প্রেমের উপাখ্যান
কনসার্ট বাজছে দূরে
শিশিরের মৃদুমন্দ পতন
গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে
রাত্রির আশীর্বাদ নেবে বলে;
কালপুরুষ, তার তরবারি খুলে এইমাত্র
স্বাতি নক্ষত্রের দিকে ছুঁড়ে দিল—
সেটা ভালবাসা না, রাগ বোঝার আগেই
মায়া-পৃথিবীর সব পাখিরা অসময়ে ডেকে ওঠে।
সে ডাক একটা কষ্টকল্প প্রেমের উপাখ্যান লেখে।
কবিতার পূর্বপুরুষ
কী ভাবে ভাঙবে বেড়া! কী ভাবেই-বা
সমতলের চিহ্ন ফুটে উঠবে ত্রিমাত্রিক!
যেন এই সন্দেহ সম্ভাবনা থেকেই ভাঙন
শুরু হল; সে এক এলাহি ব্যাপারস্যাপার!
ঘাত প্রতিঘাত, এত দ্বন্দ্বময় অবক্ষয়ের
পরেও ত্রিশূল বিদ্ধ করে স্থাপনের ভিত;
নির্মাণ ভাঙনকে বিন্যাসে রাখতে গিয়ে
হাঁটু ভাঙা দ’ গোছের কিছু হয়ে যায়;
সৌন্দর্যবিলাসী মানুষের কাছে নতুন
নির্মাণ চাই, কবিতার শরীরে জ্বলে উঠুক
ম্যাজিক লণ্ঠন, অপার্থিব রূপকথা রাত;
আতপচালের গন্ধ, মালসা জ্বাল দিক
হবিষ্যান্নের হাত, কবিও যেন তীর্থের কাক
ঠোঁট ছোঁয়ালেই কবিতার পূর্বপুরুষ জেগে উঠবে!
লখলাইনে কেটে যায় গলা
তোমার বেড়ার পাশে ফুটে আছে জুঁই
আমার বাগানবাড়ি নিলামে উঠেছে।
দুঃখের সে রাত্রিজল টুপটাপ ঝরে
ভগ্ন ডানায় উড়ানের সাধ নেই
ক্ষতচিহ্ন ধরে রাখে বুক
সমূহ বিচ্ছেদ নিয়ে সম্পর্ক দাঁড়িয়ে।
এইবার তারাগোনা খেলা
এইবার গাঢ় মনখারাপ ফিঙেপাখির লেজ
ক্যানভাসে ফুটে ওঠে হাজার হিজিবিজি
ছবিআঁকা চেষ্টার বাতুলতা
সময়ের সুতো ধরে টান মারে অপটু লাটাই
লখলাইনে কেটে যায় আমাদের গলা!
প্রাক্তন
এখনও কি তোমার বেড়ার পাশে ফুটে থাকে জুঁই!
উঠোনের দড়িতে স্নান শেষে মেলে দাও শাড়ি!
ভিজে চুলে জড়াও গামছা, ত্রস্ত হাতে সবজি কাটো
বঁটিতে, ডাল সম্বরা দাও নিপুণ হাতে!
সবাইয়ের খাওয়া শেষ হলে তবে খেতে বসো!
তোমার পোষা ময়নাদুটোর সঙ্গে একটু গল্প করে
বিকেলে মেয়েকে আনতে স্কুলে যাও? আমার কিন্তু
মাঝেমধ্যে খুব লোভ হয়, যদি তোমার যাওয়ার
পথের পাশে একদিন দাঁড়াই, থতমত তুমি গায়ে
জড়িয়ে নেবে শাড়ি! ভয় পেয়ে নিচু স্বরে বলবে,
'এমা, তুমি! এক্ষুনি চলে যাও। কে দেখে ফেলবে!'
ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার স্বামী যদি
জানতে পারেন! আমি যে তোমার প্রাক্তন স্বামী!
রবীন বসু
189/9, Kasba Road, Kolkata -700042
Ph- 9433552421 WhatsApp: 8017135485
--
| |||||||||||||||
| |||||||||||||||
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks