গল্প।। দরজায় টোকা।। নাহিদ হাসান রবিন।।story by nahid hasan robin--kuasha

গল্পঃ



দরজায় টোকা
নাহিদ হাসান রবিন


এই বাঁদরটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। ভোর রাতে শোবার পর এইবার দিয়ে পাঁচবার এলো এই ঘরে। একবার আসে পানি নিতে, একবার আসে লাইটার নিতে আবার আসে সিগারেট নিতে। আবার কেন এসে দরজায় টোকা দিচ্ছে কে জানে। আর উঠতে পারব না। উজ্জ্বল আমাদের বন্ধু। আচরণে বাঁদর প্রকৃতির হলেও, ছেলে হিসেবে ভালো বটে। কাল আমরা চার বন্ধু ওরই এক কাজে জামালপুর এসেছি। সরাসরি বাসে এলে অনেক পথ ঘুরে আসতে হয়। সময় বাঁচানোর জন্য ভ্যান, রিক্সা আর নৌকায় আসতে বাসের চেয়ে বেশি সময় লেগে গেছে। জামালপুর কম পথ নয়। মাঝখানে একটি জেলা পার হয়ে আরেক জেলার অংশবিশেষ পার হওয়ার পর জামালপুর শহর। সারাদিনের জার্নি আর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যার খানিক পর আমরা জামালপুর এসে পৌঁছিয়েছি। উজ্জ্বলের সখ চেপেছে বিদেশ যাবে। আমাদের এলাকায় এত আদমব্যাপারি থাকতে ওর মনে ধরেছে জামালপুরের হানিফ নামের এই আদমব্যাপারিকে। কবে নাকি ওর দাদা হজ্ব থেকে আসার সময় এয়ারপোর্টে এই হানিফের সাথে পরিচয় হয়েছে। মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে কথা হয়। উজ্জ্বলকে কানাডা পাঠাবে। উজ্জ্বলও মরিয়া হয়েছে কানাডা যাবে। আরে বাবা এয়ারপোর্টে একজনের সাথে পরিচয়, তার সাথে শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে কথা বলে দশ লক্ষ টাকা দিবে কানাডা যেতে। এই লোক ভালো না মন্দ এটা বোঝারও একটা ব্যাপার আছে। কে শোনে কার কথা। অনেক বলেও কাজ হয়নি। যা বাবা তোর এত সখ যা তুই কানাডা যা। গতকাল সকালে আমরা চার বন্ধু রওনা করে সন্ধ্যার খানিক পর এসে পৌঁছিয়েছি।

আমরা পৌঁছার পরই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। এই শহরে আমাদের আগে কখনো আসা হয়নি। শহরটা একেবারে অনুন্নত। একটি রাস্তার দুপাশে কিছু টিনশেটের দোকান পাঠ। দু-একটি বিল্ডিং আছে। হানিফ সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হলো একটি হোটেলে। ভদ্রলোক আমাদের নাস্তা করিয়ে নিয়ে গেলেন পাশের একটি আবাসিক হোটেলে। এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আমি সিঙ্গেল রুম থাকলাম। হোটেলটি বেশ পরিচ্ছন্ন।

রাত দশটা বেজে চলছে। বৃষ্টি ছাড়ার কোন লক্ষণ নেই। হানিফ সাহেব লোকটা বেশ অতিথি পরায়ন। আদমব্যাপারিরা অবশ্য এমনই হয়। তাছাড়া এই ব্যবসা চলবে না। রুমে ঢোকার সময় পানির বোতল, কলা, রুটি, বিস্কুট, সিগারেট সবই নিয়েছেন। কিন্তু সারাদিনের জার্নির পর এখন এসব খাবারে হবে না। আমাদের দরকার ভারি বাঙালি খাবার। হানিফ সাহেব কোথায় যেন কল করে একটি মাইক্রো নিয়ে এলেন। আমরা মাইক্রোতে উঠে খাবারের হোটেলে গিয়ে খাবার খেয়ে আবার রুমে চলে আসি।

রাতে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলো। আগামীকাল সকালে এক লক্ষ টাকা দিবো আর পনেরো দিন পর ঢাকাতে দেখা করে বাঁকি নয় লক্ষ টাকা দেয়া হবে। রাত গভীর হতে থাকে। বৃষ্টির গতি মনে হয় আরও বাড়ছে। হানিফ সাহেব বাসায় না ফিরে আমাদের সাথে হোটেলে থেকে গেলেন। আমাদের রুমের পাশের রুমেই তিনি থাকলেন। কারো চোখে ঘুমের ভাব নেই। রাত দুটো বাজে। সময় কাটানোর একটা পথ তৈরি করা দরকার। হোটেল বয়কে ডেকে এক সেট তাসের ব্যবস্থা করা হলো। ভোর রাত পর্যন্ত তাস খেলা চলে।

পাঁচটার দিকে আমরা শুয়ে পড়ি। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। হোক, আমাদেরও সকালে ওঠার তাড়া নেই। কিন্তু এই উজ্জ্বল বাঁদর থাকলে কাউকে ঘুমাতে দিবে? বললাম না, একবার আসে লাইটার নিতে, একবার আসে পানি নিতে আবার আসে সিগারেট নিতে। এই সাত সকালে কেবল একটু ঘুমিয়েছি, এখন আবার তোকে দরজায় টোকাতে হবে। যাহ এখন খুলতে পারব না। না আবার টোকা। চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে আমি তো হকচকিয়ে যাই। আরে বাবা, এই সাত সকালে এই হোটেলে পরীর দল এলো কিভাবে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ নানান রঙের পরী। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি না তো। চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিয়ে আবার তাকাই। এবার রীতিমতো হকচকিয়ে যাই। সত্যি সত্যি কয়েকজন নারী। কিন্তু এরা এখানে কি চায়। একজনের হাতে দেখলাম শাখা পরা। আর একজন আমাকে দেখে কেমন মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমারও কেমন চেনা চেনা মনে হলো। ঠিক করতে পারলাম না। সবার মুখে গাঢ় প্রলেপে পাউডার লাগানো।
লম্বা মতোই মেয়েটি হাতে শাখা পরা, আমাকে বলল- কোন কাজ করবেন নাকি?
--এটা কি আমার বাড়ি নাকি? কি কাজ করাবো? যাও এখান থেকে।
এক পা এগিয়ে মেয়েটি আমার থুতুনিতে টোকা দিয়ে বলল- খোকা দেখি কিছুই বোঝে না। এই রেখা খোকাকে একটু বুঝিয়ে বল। একথা বলতেই পিছন দিকে ফেরা মেয়েটি এদিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলো। আমার বোঝার আর বাঁকি থাকল না এরা কি চায়। হায়রে জীবন! বহু পেশাদারকে ফেরি করতে দেখেছি। আজ এই পেশার ফেরিওয়ালাও দেখলাম। আমি ওদের ধমক দিয়ে বিদায় করে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম। রেখা নামটি আমার মনে আছে। মেয়েটিকে চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু কোথায় দেখেছি? মনে করতে পারছি না। চার বন্ধুকে ডাকলাম। টেবিলের উপর থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো পানি খেয়ে নিলাম। কেমন অস্থির লাগছে। এই সকালে কাদের খপ্পরে পড়লাম বাবা। যাক বেঁচে তো গেছি। কিন্তু রেখা নামের এই মেয়েটি কে? দরজা খোলার পর এই মেয়েটিই সামনে ছিল। আমার চোখে চোখ পড়তেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যাহ্ কি সব ভাবছি। এই প্রথম এই শহরে এসেছি। এখানে কোন না কোন রেখা, তাকে চেনার কথা না। কিন্তু মেয়েটিকে চেনা চেনা মনে হলো কেন? আর মেয়েটিই বা আমার চোখে চোখ পড়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো কেন?

চারজনই বিষয়টা ভাবতে থাকি। মেয়েটির থুতুনির নিচে একটা তিল আছে। তিলের উপর কয়েকটা চুল। না না, এই মেয়েটি আমার চেনা। রেখা, রেখা, হ্যাঁ এই সেই রেখা, আমাদের সাথে কলেজে পড়ত। থুতুনির নিচের এই তিলটাই মনে করিয়ে দিলো। আজ থেকে আটাশ বছর আগে আমরা এক সাথে কলেজে পড়তাম। তারপর আর দেখা হয়নি। মেয়েটি ছিল অনেক স্মার্ট আর অহংকারী। ছাত্রী হিসেবেও ভালো ছিল। দীঘির পাড়ের আফজাল উকিলের ছোট বোন। শুনেছিলাম ওর অনেক ভালো বিয়ে হয়েছে। বর বড়লোক মানুষ। ঢাকায় থাকে। এবার সবই মনে পড়ছে। কিন্তু রেখা এখানে, এই পেশায়? জীবন কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। রেখার মতো মেয়েও আজ দরজায় টোকা দেয়।


Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন