সিনথিয়া রহমান এর দশটি কবিতা
পালক ছেঁড়া মৌনতা
দিগন্তে জ্বলছিল একটি নিমগ্ন চিৎকার।
তার বর্ণ ছিল ধোঁয়া-ধরা পায়রা-এর চোখের মতো ধূসর,
আর সে উড়ে গেছিলো,
একটা পিছুটান-বিহীন ঘ্রাণের পিছুপিছু,
যেখানে ফুল ফোটে না, শুধু ঘুম পেকে যায় শব্দের পাঁজরে।
আদিম কালের উপসংহারে
কোনো এক রন্ধ্রে আটকে থাকা
মৌন ভাষায় লেখা হয়েছিল তার নাম,
যা উচ্চারণ করলে নাকি ফুসফুস থেকে ধুলোর মতো উড়ে যায়
তামাক মাখানো অতীত।
তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি
তোমার মেকি ভিজে-পড়ে থাকা বুকের শোকচিহ্ন,
যেখানে একসময়ে রাখা ছিলো
বারো আঙুলে বোনা দীর্ঘশ্বাসের চাদর।
সে শুধুই বিদ্রোহ নয়,
একটা ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে আসা ফুসিল,
যার ওপর আঙ্গুল বুলিয়ে
তুমি বলেছিলে,
এতটাই নরম ছিলে, অথচ ভাঙলে ধাতব শব্দ হয় কেন?
আসলে আমরা কেউই বুঝিনি,
ভালোবাসা শেষ হয় না,
শুধু ছায়া বদলায়,
আর হাড়ে হাড়ে জমে যায় কিছু পালক-ছেঁড়া মৌনতা।
মৃত আত্মার কফিন
একেকটা রাত যেন শরীর বদলায়,
আলোর মর্মরে ফাঁটল ধরে,
আর সেই ফাঁটলে আটকে যায় আমার প্রার্থনা।
তুমি আসো না, তবু প্রতিটা নিঃশ্বাসে
তোমার অনুপস্থিতি জমে কুয়াশার মতো,
ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে
এক অনুচ্চারিত মৃত্যুর গন্ধ।
আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি,
চেনা মুখটা নেই,
শুধু এক শূন্য চোখ,
যার পেছনে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
সব স্মৃতি এখন কাঠ হয়ে গেছে,
নিবে গেছে যত প্রদীপ,
এখন এই দেহ, এই অপেক্ষা,
এই ছায়া…
সবকিছুই বোঝা টানে।
এ যে মৃত আত্মার কফিন।
দৃষ্টিশূন্য দহন
নির্জন দুপুরের নিস্পন্দ আলোর নিচে জানে হৃদয়ের অন্তর্গত অস্থিরতা,
কতটা দহন জমলে, চক্ষু দু’টি অশ্রুবাহিত হয়ে বয়ে চলে অজানা ভাষায়!
কতখানি নিরুৎসাহ জমলে, রঙের প্রলেপও ফিকে হয়ে পড়ে অনুভবহীনতায়।
দু’ধারবেষ্টিত মেঠোপথ জানে প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস কতটা স্থবির হতে পারে,
তরুশাখার ছায়া জানে,কতটা নিশ্চুপ চাহনি অপেক্ষায় পোড়ে প্রতিনিয়ত।
কৃষ্ণচূড়ার পত্ররন্ধ্রে লুকানো অগ্নিঝরা স্পর্শে মস্তিষ্ক রক্তিম হয়ে ওঠে,
দহন হয়ে পড়ে দৃষ্টিশূন্য!
অতল নিশীথের নিস্তব্ধ স্তব্ধতায় লুকিয়ে থাকে একাকীত্বের দীর্ঘ গল্পরাশি,
নির্মম নিঃসঙ্গতা জানে, কতটা ভার সহ্য করে হৃদয় ডুবে যায় রাত্রির গহ্বরে।
ক্লান্ত নিশ্বাসে গেঁথে যায় প্রতিটি ব্যথা, যা ফিরে আসে না কোনোদিন।
তবুও, একমাত্র তুমি জানলে না,
একটুও অনুভব করলে না,
কীভাবে এক প্রাণ প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলীন হয়ে গেলো সময়ের গর্ভে।
আর এখন?
এখন সে প্রাণের পরিচয় শুধুই,
একটি নির্বাক, বিমুখ, ভগ্ন ধ্বংসাবশেষ।
একটি মৃত ফুলের স্মৃতিচিহ্ন
আমি রেখে যেতে চাই না কিছুই,
যা আমার মৃত শরীরের দিকে
কোনো অতৃপ্ত চোখ ফেরায়।
চাই না, কেউ খুলে দেখুক
আমার পুরনো ডায়েরি,
যেখানে শব্দগুলো ছিল না কখনো নির্দোষ,
আর অনুভবগুলো ছিল পাপমুক্ত কিন্তু নোনা।
আমার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে
যারা চোখ ভিজাবে,তাদের চোখে জল নয়,
বাকি থাকুক কিছু সংবরণ…
তারা জানুক, জীবিত থাকতে আমি কাউকে
অভিযুক্ত করিনি,
তবু মৃত্যুর পর অভিযুক্ত হওয়ার দায়টাও
আমার নয়।
যারা পাঁজরের হাড় গুনে কবিতা খোঁজে,
তাদের বলো,
শুধু কবিতা নয়, হাড়েও ব্যথা হয়।
আমার শ্বাসনালীর উপর গুচ্ছগুচ্ছ পৃষ্ঠা রাখিও না,
সেখানে কোনো নতুন বাক্য আর উঠবে না।
যার নামে আমি একদিন
নামহীন ভালোবাসা উৎসর্গ করেছিলাম,
তার নাম আমি নিজেই ঘষে মুছে ফেলেছি।
কারণ, মৃত মানুষের ভালোবাসা কারো ঘরে
অপশগুনের মতো ঝুলে থাকে।
কবরের মাটি যেদিন
আমার নখের রেখা মুছে দেবে,
তুমিও সব ফেলে দিও,
কারণ আমি আমার ব্যক্তিগত না।
একটা মৃত ফুল যেমন
স্মৃতির বাগানে আগাছা হয়ে যায়,
তেমনি আমিও শুধু একটা শেষ পাতার দাগ।
আর কিচ্ছু না।
নির্ঘুম রাত
জেগে আছো চাঁদ?
রাতের স্তব্ধতা ভেঙে তোমাকেই তো খুঁজি
প্রতিটা নিঃশ্বাসে অদৃশ্য কারো ওজন টের পাই,
এটা কোনো বিচ্ছেদ নয়,এটা প্রেমের রোগ,
যেখানে ঘুমও রাত্রির কাছে ঋণী হয়ে থাকে।
তুমি কি জানো চাঁদ,
যার জন্য নিদ্রাহীন চোখে তোমার আলোয় ভিজি,
সে ঘুমায় নিশ্চিন্তে,
আমার হাহাকারের ঢেউ তার স্বপ্নে পৌঁছায় না কখনও।
তবুও তার নামের শব্দে
মনের গহীন গলিতে বজ্র নেমে আসে,
আর তোমার আলোয় জেগে থাকে
ভালোবাসার মরচে পড়া চিঠির মতো একাকী হৃদয়।
চাঁদ, বলো,
কখনো কি কাউকে ভালোবেসে নিদ্রাহীন থেকেছো?
রাতজাগা কারো চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছো?
আমার এ নির্ঘুম রাতের অজুহাতে
তোমাকেই আপন ভেবেছি,
কারণ প্রেমে আক্রান্ত মানুষ যেমন নিঃসঙ্গ,
তেমনই অবিরাম জেগে থাকে
তার প্রিয়জনের অবর্তমানে।
চাঁদ, তুমি কি আমার ব্যথার সাক্ষী হবে?
দূরদর্শী সুখের সন্ধান
পুরনো বইয়ের গন্ধে ভরা লাইব্রেরির নীরব কোণে
একটা কবিতার বই উল্টে-পাল্টে দেখছিলাম।
হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো নরম কণ্ঠ,
আপনি কি শব্দ বুনতে ভালোবাসেন?
চমকে তাকিয়ে দেখি,
একজন অচেনা ভদ্রলোক আমার হাতে ধরা বইয়ের
শিরোনামের ওপর হাত রাখছেন মৃদু আগ্রহে,
চোখে যেন গভীর বেদনার সাগর
আর ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি,
যেন অনেকদিনের পরিচিত কোনো আত্মা
হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না
শুধু ফিসফিস করে বললাম,
একটি কবিতা চাই,
যেখানে আমার দুঃস্বপ্নের রাতগুলো
শান্তির ভোর খুঁজে নেবে।
যে কবিতার বুকে আবেগের যাবতীয় উষ্ণতা
চুম্বন দিতে-দিতে বলতে পারবে
এখন থেকে তুমি আমার এক দূরদর্শী সুখ,
আমৃত্যু নির্ভরতা।
আলোকহীন ব্যঞ্জনা
নিশ্চিহ্ন হোক চিরতরে সকল অব্যক্ত আহাজারি,
যা বুকে জমে আছে পাহাড়ের মতো,
যার ওজন রাতের নীরবতা পর্যন্ত টেনে আনতে পারে এক মৃত্যুর নিমগ্নতা।
স্মৃতির চূর্ণ খণ্ড যেন আর না খোঁচায় অস্থিমজ্জা,
প্রতিটি ব্যর্থ প্রতীক্ষা যেন নিজেই নিজেকে কবর দেয়,
ভালোবাসার নাম নিয়ে আর কোনো ছায়া যেন না ভেসে ওঠে চোখের পাতায়।
জীবনের প্রতিটি অপূর্ণতা, প্রতারণা আর থেমে যাওয়া স্বপ্ন
নির্বাক নক্ষত্রের মত নিভে যাক সময়ের গর্ভে।
"নিশ্চিহ্ন হোক চিরতরে হৃদয়ের মৃতপ্রায় ইতিহাস"
নিভে যাওয়া বিভ্রম
প্রাচীন কোনো শূন্যতাকে চিবোতে থাকা এক গন্ধ,
ভিতরে ভিতরে পঁচে যাওয়া আলো
নিজেই নিজের ছায়ায় পা গলিয়ে পড়ে।
একটা ধাতব শব্দ
পিছলে যায় মগজের নিচের কর্দমে,
চোখ আর কর্ণের মাঝখানে কেমন এক পেঁচানো জল,
যার রঙ নেই, স্পর্শ নেই, তবুও রক্ত জমে থাকে তলায়।
সব নীরবতাই জন্ম নেয় ধ্বংসের গর্ভে,
আর সেই গর্ভে,
জেগে থাকে একজোড়া ভাঙা পালক,
যা উড়তে জানে না,
তবু দিগন্তকে অবিশ্বাস করে।
চাঁদের সোনালী কফিন
রাত্রির এই পরম ছায়াচিত্রে
আমি এক যাযাবর আত্মা,
শব্দহীন অন্ধকারে উড়ি ক্ষয়িষ্ণু চিঠির মতো,
যার গায়ে এখনো লেগে আছে তোমার
শেষ চুম্বনের হিমঘ্রাণ।
অন্তর্জ্বালার দীপ্তি নিভে গেছে বহু আগেই,
তবুও এই হৃদয়,
ভগ্নপ্রায় নীলাঞ্জন মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনে
প্রতিবার তুমি নিঃশব্দে স্বপ্নে এলে।
আমার কল্পনাজুড়ে
তুমি এখনো জেগে আছ এক অমর কবিতা হয়ে,
অক্ষরহীন, অথচ ব্যাকরণে পরিপূর্ণ;
তোমার স্পর্শের ছায়া পড়ে
নষ্ট সময়ের গায়ে।
চাঁদের কফিন বানিয়েছি আমি,
তোমার অনুপস্থিতির শেষ কাঠামো দিয়ে,
নির্জনতা, স্মৃতির ছাই, আর
একটি অপ্রকাশ্য চুম্বনের রূপালি কষ্টে গড়া।
ওই কফিনে ঘুমিয়ে থাকে
আমার সব অপূর্ণ কবিতা,
ভুল ঠিকানায় পাঠানো সব প্রেমপত্র,
আর তোমার চোখের শোকরঙা নীরবতা।
আকাশের হেমন্ত-নীল আলোয়
প্রতিটি রাত একেকটা অন্ত্যেষ্টি,
আর আমি, এক চিরজাগ্রত শববাহক,
ভাসিয়ে দেই চাঁদের সোনালী কফিন
ভবিষ্যতের কালো নদীতে।
তুমি যদি কখনো ফিরে আসো,
জেনো, কবিতা একা মরে না;
সে শুধু ঘুমিয়ে পড়ে
তুমিহীন আলোয়।
তুমি না হলে আমি পথ ভুলে যাই
নিশব্দ এক আবেগে যদি ভেসে যাই,
আমার গলায় ঝুলে থাকা মৌনতা খুলে নিও ধীরে...
ভেবো না, আমি চলে যাবো চিরতরে,
আমি কেবল হারিয়ে যেতে চাই তোমার চোখের গভীরতায়।
অন্ধকার কোনো নদীর মতো ভেসে যেতে দিও,
কিন্তু রেখো না একফোঁটা আলোও নিভে যাওয়ার মতো,
আমার মনের ঘরে থাক না একটি দীপ্ত জোনাকি হয়ে...
যে আলোয় তোমাকে ছুঁয়ে দেখা যায় বারবার।
আমি তীব্র হতে চাই না কখনও,
তোমার ঠোঁটের কোণে জমে থাকা নিরবতা যেন গলিয়ে দিতে পারে আমার সকল ভয়,
যদি কখনও চলে যাই...
তবে বিশ্বাস রেখো, আমি হারিয়ে ফেলিনি তোমাকে,
শুধু ঠিকানা মেলাতে সময় লেগে যায় আমার মতো পথভ্রষ্ট হৃদয়ের।
তুমি চুপচাপ থেকো, আমি ফিরে আসবো,
ঠিক সেই ছাদের কোণায়,
যেখানে একদিন তোমার নিঃশ্বাসে বাতাস গন্ধ পেয়েছিলো চেনা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks