দশটি কবিতা।। গোলাম রববানী।।10 poems by golam rabbani--kuasha

   

 দশটি কবিতা
 গোলাম রববানী
প্রবোধ পান্ডুলিপি 

জনগণ দানব হলেই সরকার ভোঁতা হয়ে যায়,
সরকার দানব হলেই তো তবে জনগণ গোলাম হয়।
বসে আছে উষ্ঠা খেয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধ বারুদ-
যেন রক্তিম সূর্যের কোলে! তীব্র তাপের গাঢ় দুর্যোগে!

বাড়ন্ত বাঙলার চেহারা উজল হতে হতে 
দেখলাম, বহু হারামির বিপুলা রূপ আগুন!
দিনের আলোর মত আলোভূক গোগ্রাসে চিবায় 
বসে আঁধারের পেটে, লুটে বিদ্যুৎ প্রবাহ বিদঘুটে। 

ফিরছে আকাশে মেঘ! ছেঁড়া ছেঁড়া নীলে এই বুঝি 
ভাসছে পেঁজা তুলার মতো এ পৃথিবী, 
ভাবনার কলকব্জাগুলি ধরে জংরং জনলয়ে,
করুণায় আবিষ্ট ইন্দ্রিয়ে জটিল চিহ্ন স্নায়ুর আতঙ্ক!

সর্বত্রেই বিমুক্ত প্রান্তের মতো খোলামেলা ঘরে নিত্যকার
বহুরূপ ধরে! মগজ খুলির মধ্যে ঘসেটি বেগম লাইনে
গিরগিটি বিফল লালন বুঝেশুনেই রয়েছি বসে!
তালুতে এখন তরতর করে বাড়ছে বিষাক্ত গাছ!

গাছের প্রসার বাড়ে সময় না-কি দখলের বাঁধ
জুলাই রক্তের সঙ্গে পুঁজিবাদী সুযোগসন্ধানী 
মুখে মুখে রাম রাম জপে! মালা আর তসবিহ কাঁদে!
ইস রক্তিম লাল হয়েছি! জনগণের পাদুকা 
আস্তেধীরে ভরে ওঠে গলা- লজ্জা লজ্জা আর ইবলিশ প্রাণ
আমার প্রবোধ পান্ডুলিপি জুড়ে স্বার্থেরই প্রবল বিজয়।


চিরজাগ্রত কবিতা

এ পৃথিবী ঘুমাতে ঘুমাতে জেগে ওঠে
আবার জেগে উঠতে উঠতে ঘুমিয়ে পড়ে
রক্ত-ঘামে, শ্রান্ত-ক্লান্ত আর পুণ্য-পাপে

কবিতা তো কখনোই ঘুমাতে পারে না!
জেগে থাকে ইতিহাসে- দর্শনে অথবা স্বপ্নে
যেদিন কবিতাটি জাগবে ঈশ্বরই হাসবে...

সেদিন হয়তো ভোগ লোভের এ পৃথিবীতে
থেকে যেতে না চাইলেই ছেড়ে ছুড়ে যেতে হবে
ঘুমিয়ে যেতেই হবে আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। 


শিকড়, মাটি আর স্মৃতি 

পিপীলিকা আসলে জানে না পাখা গজালে কী হয়।
মানুষ জানে না- কারণ মানুষের তো পাখা নাই!
তবে প্রকৃতি বুঝি বুঝেছে তাই যত্নে আগলে রেখেছে। 

আমার গ্রামের বাতাসে কতশত ভিজেছি আমি
জল মেখেছি আমার সারা গায়ে, রাস্তাঘাট বেশ চিনি
আগান বাগান পোকামাকড়ের ঘরবসতি নিত্যসঙ্গী। 

গ্রাম্য কুকুরের ঘেউঘেউ সারারাত জেগে আমি
পড়ার টেবিলে নির্ঘুম শুনেছি; বিরক্তি লাগেনি মোটেও
রাতদুপুরের শিয়ালের হুক্কাহুয়া আখক্ষেত স্মৃতি। 

কত কেঁটেছি সাঁতার খাল-বিলের পানিতে আমি
ধরেছি বিলের মাছ কত কো'র হাবড় কাঁদায়, 
তুলে এনেছি পেয়াজ রসুন গিমি আর কাঁচামরিচ। 

কত শুনেছি ভোরের আমি মোরগ ডাকা সকাল
দেখেছি রাঙা প্রভাত ঘাসের ডগায় শিশিরের ফুল 
মন ভিজিয়েছি আমি, ছুঁয়েছি খালি দু'পায়ে দূর্বাঘাস

ধুর সালার হালায় কোথাকার গল্পের ছেঁড়া কাঁথায় 
ইনিয়েবিনিয়ে রটিয়েই চলে মিথ্যা কারিগর;
গ্রামীণ প্রকৃতির চেনা আমি- আমি মাটির সন্তান!

আমার গ্রামীণ আমি শিকড় মাটি আর স্মৃতির 
প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা আমি চিনেছি আমার ভূমি
যা-কিছু দেখেছি চোখে অস্তিত্বের উঠোন জুড়েই
ঢোল পেটানোর কিছু নেই- গ্রামীণ প্রকৃতিই স্বজন।


বর্ষায় রথে শাপমোচন 

হে শারদী, কীভাবে আর জানান দেব বেশ,
আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে সুখ সংকটে দেশ!

থইথই জলে বৃষ্টি ভেজে, বারিধারার সুর,
নিষ্প্রাণ দেহে দেহ পুড়ে, বিলীন হলো অসুর।

দলে দলে শিয়াল ডাকে, পথিক চলে পথে,
ব্যাঙের বীণা বাজায় বাঁশি, ঝিঝি পোকার রথে।

চতুর্দিকে হেলান দেয় সব অন্ধকারের শব,
পূর্ণ করে শাপমোচন এই পাপমোচনের রব!

ভরা বাদর মাহ ভাদর বিদ্যাপতি বলে—
জগৎ-সময় প্রিয়হীন মন, দাউদাউ করে জ্বলে।


ইতিহাসের মৌতাত

এ পৃথিবীতে কার কত অবদান কে বা রাখে মনে,
যারা দিনরাত মানুষের রক্ত নিয়ে হলি খেলে-
সুনিশ্চিত জেনে রাখে তারা ডুবে যায় ঘৃণার সাগরে;
হোক সে ঈশ্বর কিংবা ভগবান; সাধু শয়তান হও সাবধান।

১০মে শুধু ১০মে নয়- সময়ের চাকা নয় এতটা অসহায়-
শুনেছি সময়ের একফোঁড় আর অসময়ের দশফোঁড়;
সকলেরই ফাঁটা ফোঁড় আছে সময় থাকতে করে নাও সম্বল-
সামনে যেতে যেতে পেছন ফিরে হেসে ওঠে ইতিহাস ধায়।

এ পৃথিবীতে কার কত অবদান কে বা রাখে মনে,
ভুলের বাগিচায় ঝরাতে হয় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার রাঙাফুল;
ঝরে গেলে বাড়ায় অজস্র গুণ কোমল সৌন্দর্যের বাহার-
ভোলা যায় না প্রচ্ছদ- প্রথম পৃষ্ঠার এ উজ্জ্বল মানচিত্র। 

সিদ্ধ হতে হয়- অঙ্গার হতে হয়- জ্বলেপুড়ে মন ও মননে,
নিষিদ্ধ সাময়িকীর নিষিদ্ধ পুস্তক বা নিষিদ্ধ পল্লী-
যুগে যুগে কালে কালে দেখেছি জেগে উঠেছে  কত,
তেমন কিছু না- দোষী হলে শাস্তি আছে জানে নিষিদ্ধিতা!

ইতিহাসের মৌতাত ইতিবৃত্তের তেমন কিছু হয়তো... 
সময় নিশ্চিত ইতিহাস আর ঘড়ির কাটার মতো 
যেমন খুশি ঘুরতে পারে, সামনে যেতে পেছনে দৃষ্টি রাখে; যৌথ মিলে কোনো কাহিনির কারুকার্যময়তার তপস্যাতে


আলোর ইনকারেক্ট পাসওয়ার্ড 

যত আলো, ততই আঁধার আরো-
যা মোটিফ- তা নকশা-চিত্র-
মনে করেন ফ্যাসিস্টের মতো সাহস এই আমাদেরও 

ঝকঝকে দিন, ঝামেলা দিন 

এহেন ঝিলমিলি রোদেলায়-মোটিফ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে; অন্ধ রাতে জ্যোৎস্না হেসে-
আমাজনিয়ার চোখ তাকিয়ে থাকে ,
নির্বাক-ধূসর শূন্যতায় ডুবে।

ওদিকে তৈগা-  এদিকে ম্যানগ্রোভ-
আলো, বাঁচার বাতাস- যেন তিমির তমিস্র!
যত আলো, ততই আঁধার আরো-
একটি খুনি শহর- নিহত সভ্য সভ্যতার জঙ্গল।
নিভুনিভু আলো- এই ডুবছে, এই জ্বলছে 
এভাবেই আলো-আঁধারির কবিতা আসছে...


ধবধবে একটি সাদা কাপড় চাই

সবুজের বুকে লাল বিস্ময় তাকিয়ে কালো চোখে
শুভ্রাংশু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে যায় দেখ নবদাগ
দাগ থেকে কিছু হলে জয় তা না হলে ভয়

ভয় নিয়ে চোখ জাগে জাগরণে চোখ বোজে 
বজ্র-বিদ্যুৎ ঝড়-ঝাপটার মতো শিহরণ দেয় এনে
কবির কালো কবিতা কতটুকু কথা শুনে শুভ্রতার
ডুব দেয় মেঘ চৈত্রের আকাশে শ্রাবণ সময় বোঝে

হয়তো ভাইয়েরা আমার 
এখনো অধীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে
কখন সমস্ত দাগ মুছে কাফনের কাপড়ের মতো এক
পূতপবিত্র বসনে হাওয়ায় জড়াবে প্রিয় পরাণ

লাল সবুজের বুকেই উড়ুক ধবধবে একটি সাদা কাপড়


জলদেবী জলবিলাসে

উন্নত ধর্ম উপসনালয়গুলোতে উন্নত প্রার্থনা চলছে
কালস্রোতের কালোর কালোরাত কাটানোর জন্যে

বেলি গন্ধরাজ হাসে সদ্যোজাত জন্মযামিনীতে 
ভূমিষ্ঠিত নিষ্পাপ ফুলশিশুটির মত
স্বর্গে নয় মর্ত্যজুড়ে আনন্দাশ্রুতে তলিয়ে দেবার জন্য
জীবনের আলাদা নাম যমের কাছাকাছি এসে 

জলপিতা আজ জলসার জলবিলাসী সারিন্দাকূলে
সুর তুলেছে পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের পল্লীগীতে
আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে
অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে…

জেনেছি মেঘ উদারাসীম পূণ্যজল মেঘবুকেই সসীম
এতো এতো এতো কেঁদে জলমেঘের আর কী হবে
বরষার সব জল যদি বানভাসি নয়নেই নাচে
রবীন্দ্র নজরুলের সব বৃষ্টির কবিতার কী হবে

কলঙ্কিত হবে প্রেমমরা এ সুরমাজলে হাবুডুবু খেলে
কলঙ্কিত হবে পীর দরবেশ পুণ্যভূমি আওলিয়াগনে

আগুন ধরুক পাপজলে মায়াবিনী চাঁদের নয়নে
সবুজের সুবিস্তৃত আলো বিধাতার রূপ বুঝি কালো
হে জলদেবী আজ না হয় স্বেচ্ছাতেই ভুল করি
সুরমাজলের জলকেলি ভুল করে বন্ধ করি বন্ধ করি

প্রথম বরষা ভেজাকদমের মতো আদরের করোটিতে
সুউচ্চ জিরাফের গর্দান থেকে ঘুমপাখি নামিয়ে আনি
নব কিশলয়ের স্বতন্ত্র ভাবনারেখা ধরে বহুদিন চলি
হে মুক্তপাখি মুক্তমনে-ই ঝেড়ে ফেলি লুকোচুরি ছলে
ডানাঝাপটে ডানাঝাপটে ফেলে দিই না সুরমাজলে
হে জালালের জালালি সব কইতর 
আজ সব এক হয়ে গিয়ে একফোঁটা জল করি পার
সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপর জলের সাগর
বন্যার বানভাসি হাসাও আওলার আওলা মজাও
জীবনের নামতো জীবন জলের নাম শুধু থাক জীবন
হে জলদেবী জলবিলাস ভুলে যাও 
হে জলদেবী হে  জলদেবী জীবনের জয়গান গাও...


যদি নিরুদ্দেশ ঢেউ উথলায়ে ওঠে

একটি সন্ধ্যা নেমে এলো, চুপচাপ বসে আছি একা-
ঝাউবন একা; নরম নরম হাওয়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলো 
নদী-নারী, পুরুষেরা- টলমল সাম্পর্কিক ঢেউ-
হারিয়েছে একান্তই কেউ- যেন সব প্রেমিক প্রেমিকা! 

ছুটছে উন্মাদ বঙ্গোপসাগরের পানি, আরো সৈকত, যোনিদ্বারের বেশ পূর্ণতা; ভাঁটার মতো বিরাগ কামনা
উড়ে চলে সঙ্গোপনে কক্সবাজারের আকাশ ঘুড়ি
হরেকরকম শৈশব স্বপ্ন সঙ্গম করে মারুত দেহে।

বালুভূমি সাজিয়েছে হাজার রকম পশরা নিয়ে
ঝিনুক সজ্জা, ঠিক যেন আনন্দেরই এক হাটখোলা 
সুগন্ধা তার- লাবনী তার-  মায়াফ্লুতে ছড়িয়েছে
ইনানি আর হিমছড়িরূপ- মহেশখালী মহেশ গল্প

জ্যেষ্ঠের শ্রাবণ মেঘ বাদলে আকাশের চোখ যেন ছুঁয়ছে-
দেখছি আমি আর আমাদের ট্যুরিস্ট সঙ্গী আর অন্যান্য;
ঝাউগাছ দুলছে পাতায় পাতায় যেন আমি জলের ডগায়!
যেমনে হেলছে দুলছে কেতন আর আঠারো কোটির জাতি!

সৈকত চেয়ার- ছাতাবিলাস বালিয়াড়ি, আর ঝাউবাগান-
মায়াবী ও রূপবতী-বালুকাময় সাগর সৈকত;
একটি সাম্পান চেয়ে আছে- সংকটে বেশ ভূমিমাটি
আর স্তনের মতো যেন বুক উঁচিয়ে আছে কিছু পাথর..
যেমন আমরা আজ এখানে স্বপ্ন তুলে বড়ো হচ্ছি,
আর লজ্জিতা বেড়ে ওঠে সেই প্রাচীন নিরুদ্দেশে।


কেউ গাছের নিচে আগলে রেখেছিলেন

একটা গাছের মতো আমি দাঁড়িয়ে আছি কেমন করে
হালকা বাতাসে ঝরে না কখনো
গাছের সবুজ পাতা তবু ঝরানোর এ কী অপচেষ্টা! 

বড় ইচ্ছে ছিলো গাছটিকে সরিয়ে ফেলার 
কিন্তু ঈশ্বরের জন্যই হয়তো- নিধন হয়নি আর
সময়মত গাছটির পরিচর্যার সুযোগেই
গাছটিতে আজ ফুল ফোটে- জীবন মালির জন্যই-
অপার হয়েই মনেপ্রাণে যাচি এই আমি আমার কর্মকে

বনে বনে পাখি, কিচিরমিচির গানে গানে মুখরিত 
গাছের শাখাপ্রশাখে- শীতল ছায়ায় পথচারী-
গাছ ছায়া ধরে মাঝেমধ্যে নেয় যেনো গাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে 
তবু বেড়ে চলে গাছের পরিধি, রাস্তায় নামে না কখনো 
মাটি ফুঁড়ে শুকনো পাতার নিচে গাছ বেড়ে ওঠে-
গাছ তো আর টায়ার না আচমকাই লিক হতে পারে!

সবকিছু বদলাতে পারে গাছ কী বাতাস ধরে রাখে?
গাছপাতা পানি ধরে- চৈত্রের মাটি চৌচির হতে পারে-
সবকিছু বদলাতে পারে চোখের পানি কী পারে?
সময় বদলে যেতে যেতেই সময় বসে গাছের তলে।

Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন