গুচ্ছকবিতা
হাশিম কিয়াম
পাটপাতার চিঠি
মেয়েটিকে যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা
করতেই হবে চারা পাটখেত
নাকি জানতো; পাটপাতার সাথে পাল্লা দিয়ে
বাড়তে লাগলো বাবার জন্য ভাত নিয়ে যাওয়া
ছোট্ট মেয়েটির চুল, যে চুলের মেঘে লুকিয়ে
ছিলো জিউস; পাটপাতার চিঠিরা ঝরে
পড়ার পর মাটির কানে কানে বলে গেছে অনাকাক্সিক্ষত
ঘটনার আদ্যোপান্ত; বাবা টের পেয়ে সাড়ে
তিন হাত ঘর ফুঁড়ে উঠে দেখে নিমগাছে ঝুলে আছে
যুবতি মেয়ে যার এক হাতের তালুতে
লেখা ‘বাবা’ আর আরেক হাতের
মুঠো থেকে উঠছে গরম ভাতের ভাপ...
বালিহাঁস
ভাষাহীন নগরের দিকে উড়ে যাচ্ছে পিরামিডে চাপা
পড়া হলদে কথারা, নীলনদের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া
এক মেয়ে উড়ন্ত কথাদের কাছে জানতে চাচ্ছে তার
বোবা প্রেমিকের ঠিকানা, আকাশটা ফেটে যাচ্ছে
স্মার্টফোনের স্ক্রিনের মতো, উঁকি দিচ্ছে রক্তাক্ত
তারারা... নীলনদ হিমালয়
ডিঙিয়ে আছড়ে পড়ছে বিশাল সমতলভ‚মিতে, দুই পারে
রংবেরঙের মানুষ ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে
ধাবমান নদীকে... মেয়েটি হাঁটছে, ভাবছে, কাঁপছে... স্মৃতির কপাট
খুলে গেলো, প্রেমিকের ঠিকানা কি ডাকছে!... তলিয়ে
গেলো সে জলের গভীরে, ভেসে উঠলো একজোড়া বালিহাঁস...
মুখ
কোনো নারকেল বাগানে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনাগত
শতাব্দীর শব্দ-ছেঁড়া মুখ, দিনের মৃত্যু রেখা ধরে গিয়ে
সাগরতলার বিরল সংগীতের টুঁটি চেপে ধরা সভ্যতার
সাথে যুদ্ধ শেষে
ঢেউয়ের করাতের উপর ভেসে
ওঠে কলাপাতারঙা মুখ, রক্ত ঝরে, তবু কী এক মায়ার
জোছনায় ভিজতে উদগ্রীব সেই মুখ! হয়তো
কিছু বলতে চায়, কিছু শুনতেও চায়... তোমার হাতে কি
মুষ্টির চালের মতো কিছু সময় জমিয়ে
রেখেছো? খরচ করো... যাও... ফিরে এসো মুখের ভাষার
নকশিকাঁথা গায়ে জড়িয়ে, বেদনার ছাইগাদায়
বিছিয়ে দাও, বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের ঘুম-নাকাল শরীর
ঘুমিয়ে পড়–ক সব পিছুটান সত্যের কাঁচা কবর থেকে
জন্মানো সভ্যতার চোখে পুরে দিয়ে...
মা
পুরান পাড়ায় পুকুর পাড়ে তিনটি শিমুল গাছ
রঙের ছিপ ফেলে শিমুল ফুল মৃগেল মাছ
শিকার করে রেণুর ভেতর লুকিয়ে রাখে
খিদে পেটে ঘুমিয়ে পড়লে
মা বালিশের তুলা থেকে মাছ বের করে
রান্না করে রাখে
ঘুম থেকে জেগে মাছ-ভাত খেয়ে
দৌড়ে মায়ের কবরে গিয়ে ঘাসের ডগায় ফড়িং হয়ে
মাকে পাহারা দিই
বাবাকে এসব কথা কোনোদিন বলিনি
নদী
নদী, থামো
বিষাক্ত জল জমেছে প্রজন্মের ঠোঁটের কোণে
চুমু দিয়ে নিয়ে যাও সাগরে
শতাব্দীর বলিরেখায় ঘুমিয়ে ছিলো যে মানুষ তার
জন্ম দাগে লেগে আছে
আশ্চর্য বিকেলের ক্রন্দন, মানুষের গল্পের ফ্যাকাশে রং, দোলনা
থেকে উপচে পড়া হাসির
বাসি গন্ধ, রোদে মোড়া বৃষ্টির ফসিল... এসবকিছু রূপালি
জিভ দিয়ে চেটে মিশিয়ে দাও নীল জলে
ব্যথা এক নীল তিমি
যার পেটে হারিয়ে যায় যাক মহাকালের জীবনবৃত্তান্ত
অসীম শূন্যতায় বিলীন হোক জীবনের অপূর্ণ সাধের মেঘ...
কাঠগোলাপের চারা
ঘরবাড়ি নিশ্চুপ, যেন মরা মাছের আড়ৎ
ঘাসের ডগা উঁকি দিচ্ছে জানালায়
কান্নারা ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়েছে
হিপোলিটা পথ ভুলে তার বাহিনীসহ
হুড়মুড় করে পড়ে গেলো হাড়গোড়ের গাদায়
কার হাড়! কাদের উপড়ানো চোখের মিছিল! শুকনো স্বপ্নের
হাড়? কবের হিমায়িত উষ্ণতার ছাল-বাকল তুলছে
অচিন শহরের বোবা মানুষ! সাপের রূপে মুগ্ধ মানুষ বোঝে
কেবল ধবধবে শরীরের ভাষা... মনপোড়া আগুনের আঁচ
কীভাবে ছোঁবে তার রোবট-হৃদয়
বন্ধু, এই হাড়ের দেশে গজাবে কি কাঠগোলাপের
চারা! ঘরে কিংবা কবরে, কবরে কিংবা নতুন চোখে
জ্বলে উঠবে কি একঝাঁক তারা! অপেক্ষা, তুমি পাশেই
বসে থাকো...
মোহাম্মদ জসিমের ভিন্ন রঙের কবিতা পড়ুন এখানে
জিল্লুর রহমান শুভ্র'র ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ুন এখানে
ওপার বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন বসুর কবিতা পড়ুন ক্লিক
ওপারের কবি তৈমুর খানের কবিতা পড়ুন এখানে
গান
দাদা কাঁপছে
নাতির চুলের ভেতর মরা মানুষের বাস
বাবা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে ভাদরের রোদ
ফোটার আগেই
হাতের মুঠোয় তিনটি কবর নিয়ে জনসুমুদ্দুরের
ঢেউ পাড়িয়ে নাতি ছুটছে
দাদা হাসছে
আসছে ভাদরে নাকি দুটো সূর্য উঠবে
তাদের পূর্বপুরুষেরা মায়েদের চোখ থেকে জন্মানো নদীর
তলদেশ থেকে উঠে এসে গান শোনাবে যে গান পাখিরা
গেয়েছিলো পঞ্চাশ ও তিন বছর আগে
একটা গান কীভাবে সবাই ভুলে গেলো!
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,নজরুলের রহস্য,পড়ুন এখানে
লিসেল মুলারের অনুদিত কবিতা পড়ুন এখানে
ভিন্ন স্বাদের গল্প,কফি হাউজের ওয়েটার' পড়ুন এখানে
দ্রাবিড় পুত্র
চোখের পর্দা ধরে ঝুলছে লজ্জাবতী ফুল, ও মেয়ে মালা
গাঁথবে না? চোখ কি বোঝে চোখের ভাষা যখন হারিয়ে যায় কেউ
চোখের জঙ্গলে? প্যারিসকে জিজ্ঞেস করো কতোটা
জল জমা হলে দুটি চোখ
সমুদ্র হয়ে যায়... নগর পোড়া ছাই থেকে জন্মানো
মেয়ে তুমি, কীসের ভয় বলো মিষ্টি আগুনে
সাঁতার কাটতে!... ব্যাঙের ছাতার মতো প্রেম
মাড়িয়ে, এক দুপুরের রোদ মুঠোয় তোমার চোখের
আঙিনায় কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছি টাটকা ফুলের মালা
পরবো বলে, বুকের ঘরে বাসর
সাজাবে না!... জিউসের উত্তরাধিকার নই, এঁটেল মাটিতে
গড়া দ্রাবিড় পুত্র আমি, জানি না
ছলনার ভাষা... একাটা উৎসব-ভেজা রাত
হাসির মুক্তোয় সাজিয়ে, ভোরের আলো ফোটার আগেই
দুজনে রূপান্তরিত হবো আমার পূর্বপুরুষের বিরল শিল্পকর্মে...
বৃত্ত-ছেঁঁড়া সরল রেখা
নগ্ন হও, ঢেউ তোলো, ফলিত দর্শনের ল্যাবরেটরিতে সংখ্যারা
মেতে উঠুক সংগমে...জংধরা পুস্তকের পৃষ্ঠা ভিজে
যাক কামরসে, প্রসব বেদনায় গড়াগড়ি খাক
পাটিগণিতের শূন্য, জ্যামিতিক বাগানের সংখ্যার ফুল
পিথাগোরাসের কবরে ভিড় করুক... অনুর্বর সময়ের
মাথাকাটা সৈনিক কেয়ামত নামিয়ে
আনে আনুক, ডর কীসের! পৃথিবী-পোড়ানো ছাই গুলিয়ে
বৃত্তের মাঝে এঁকে দিয়ো বৃত্ত-ছেঁড়া
সরল রেখা যার প্রান্তে আমি অপেক্ষা
করবো আরেকটি পৃথিবীর জন্য...
মাছ
একসময় তুমিও মাছ হয়ে যাবে, অথচ কোথাও জল
থাকবে না, মাটির বুকে
মুখ ঢুকিয়ে চলে যেতে চাইবে পাতালে, আগুনের ছ্যাঁকা
খেয়ে লাফালাফি করবে ধুলোর যমুনায়
যেখানে হারানো
প্রেম, যা তুমি দুই পায়ে পাড়িয়েছো, টগবগ ফুটবে...
আকাশটা যেন সুমুদ্দুর, নেমে আসবে
মাথার উপরে... ডিগবাজি খেয়ে সাঁতার
কাটতে চাইবে, খিলখিল হেসে
নীল ডানা মেলে উড়ে যাবে সে আরেক
আকাশের দেশে... হয়তো
কোনো সাধু, যাকে তুমি দেখেছিলে মায়ের গর্ভে, ঘটির জলে
ভরে দেবে যমুনার বুক, তুমি ভেসে
উঠবে... গেয়ে উঠবে কি মানুষের গান!... নাকি শিকারের নেশা
জেগে উঠবে চোখের নিবুনিবু আলোয়!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks