শামসুর রহমানের কবিতায়
প্রযুক্তি ও নগর সভ্যতার সংকেত
জিয়াউদ্দিন লিটন
শামসুর রহমান বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিকতার সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তিনি প্রেম, রাজনীতি, স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর কাব্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রযুক্তি ও নগর সভ্যতার সংকেতকে কবিতার দেহে সংযুক্ত করা। বাংলা কাব্যে শহরজীবনের কোলাহল, প্রযুক্তির শব্দ, বহুতল দালানের ছায়া কিংবা টেলিফোনের রিংকে এত গভীরভাবে আর কেউ রূপ দিতে পারেননি। গ্রামবাংলার কবি জসীম উদ্দীন বা প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের ভিন্নতর ধারা থেকে বেরিয়ে শামসুর রহমান নগরজীবনের কবি হিসেবে দাঁড়িয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
ঢাকার অলিগলি, দ্রুত নগরায়নের চাপ, বিদ্যুতের ঝলকানি, গাড়ির হর্ন কিংবা বহুতল ভবনের জানালায় দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষ—সবকিছু তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে জীবন্ত চিত্রকল্পে। বিশ শতকের মধ্যভাগে টেলিফোন, রেডিও, মুদ্রণযন্ত্র কিংবা টেলিভিশন সমাজে যে নতুন অধ্যায় যোগ করেছিল, কবি সেসবকে অবহেলা করেননি; বরং তিনি এগুলোকে সময়ের কবিতা হিসেবে উচ্চারণ করেছেন। যেমন, ‘বন্দী শিবির থেকে’ (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধকালীন রেডিও সংবাদ ও মাইক্রোফোনের ধ্বনি কবিতার প্রতিরোধী শক্তি হয়ে ওঠে। আশির দশকের ‘নির্বাচিত অসমাপ্ত কবিতা’ (১৯৮৫) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন “টাইপরাইটারের কীবোর্ডে বাজে সময়ের ধ্বনি”—যা প্রযুক্তিকে যুগচিহ্ন হিসেবে দাঁড় করায়।
বহুতল ভবন তাঁর কাছে মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও একাকিত্বের রূপক। বিদ্যুতের তারকে তিনি দেখেছেন আধুনিক যোগাযোগের সঙ্গে শিকলের মতো বাঁধনের প্রতীক হিসেবে। এভাবে যন্ত্র ও নগর উপকরণ কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে রূপক ও প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
তবে তাঁর কাব্যে প্রযুক্তি কেবল তথ্য বা বাস্তবতার উল্লেখ নয়; এটি মানুষের অনুভূতির প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘নীল দিগন্তে জয়ঢাক’ (১৯৭৮) কবিতায় বিদ্যুতের আলো হঠাৎ বিস্ময়ের প্রতীক, আবার ‘স্বপ্নের দরজা খোলো’ (১৯৮৩) কবিতায় টেলিফোনের নীরবতা প্রিয়জনের অনুপস্থিতির প্রতীক। বহুতল ভবন তাঁর কাছে মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও একাকিত্বের রূপক। বিদ্যুতের তারকে তিনি দেখেছেন আধুনিক যোগাযোগের সঙ্গে শিকলের মতো বাঁধনের প্রতীক হিসেবে। এভাবে যন্ত্র ও নগর উপকরণ কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে রূপক ও প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
শামসুর রহমান যন্ত্রসভ্যতার দ্বিমুখীতা গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। ‘উনিশে নারী’ (১৯৭৫) কাব্যের কিছু কবিতায় নগরের ঝলমলে আলোর আড়ালে মানুষের হৃদয়ের শূন্যতা ফুটে উঠেছে। একদিকে প্রযুক্তি মানুষকে সংযুক্ত করছে, অন্যদিকে তা সৃষ্টি করছে নিঃসঙ্গতা। বহুতল ভবনের অসংখ্য জানালায় অসংখ্য মানুষ বাস করে, কিন্তু তাদের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকে টেলিফোনের রিং বা লিফটের যান্ত্রিক ওঠা-নামায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গেও প্রযুক্তি এসেছে তাঁর কবিতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রেডিওর প্রচারিত সংবাদ মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল—এ রূপটি তিনি ‘বন্দী শিবির থেকে’ গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় ধরেছেন। আবার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মাইক্রোফোন, পোস্টার ও লাউডস্পিকার প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যেমন ‘স্বাধীনতার কবিতা’ (১৯৭৩)–য় তিনি লিখেছেন—“মাইকের শব্দ ছিঁড়ে ফেলে রাতের অন্ধকার।” কবি বুঝেছেন প্রযুক্তি কেবল যন্ত্র নয়, এটি মুক্তির হাতিয়ারও।
বিশ্বায়নের যুগে এসে শামসুর রহমান আরও একটি সংকেত অনুধাবন করেন—তথ্যপ্রযুক্তির জালে আবদ্ধ মানুষের নিঃসঙ্গতা। আশির দশক পরবর্তী কবিতায় তিনি কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও বৈশ্বিক মিডিয়ার প্রভাব উল্লেখ করেছেন। তাঁর একটি কবিতায় আছে—“কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অক্ষরও জানায় আমার একাকিত্ব”—যা বিশ্বায়নের ছায়ার নিচে মানুষের বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। মানুষ তখন একসঙ্গে সংযুক্ত থেকেও দূরে সরে যায়, আর কবি এটিকে আধুনিক দাসত্ব হিসেবে উপলব্ধি করেছেন।
সবশেষে দেখা যায়, প্রযুক্তি ও নগর সভ্যতাকে তিনি কেবল প্রেক্ষাপট হিসেবে নয়, মানুষের অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতায় টেলিফোন, বিদ্যুৎ, লিফট, বহুতল দালান কিংবা কম্পিউটার—সবই হয়ে উঠেছে মানবিক সম্পর্কের সংকেত। তিনি দেখিয়েছেন আধুনিকতা যতই অগ্রসর হোক, মানুষের একাকিত্ব ও মানবিকতার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই শামসুর রহমানের কবিতায় প্রযুক্তি ও নগর সভ্যতার সংকেত কেবল সময়ের চিহ্ন নয়, বরং মানুষের মনোজগতের কাব্যিক মানচিত্র। এই মানচিত্র আজও আমাদের সমকালীন জীবন ও ভবিষ্যতের অস্থিরতার সঙ্গে গভীরভাবে মিলে যায়।
সূত্র: বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২), স্বাধীনতার কবিতা (১৯৭৩), উনিশে নারী (১৯৭৫), নীল দিগন্তে জয়ঢাক (১৯৭৮), স্বপ্নের দরজা খোলো (১৯৮৩), নির্বাচিত অসমাপ্ত কবিতা (১৯৮৫)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন