উত্তরাধুনিক কাব্য যাত্রা। মতিন বৈরাগী
এই কাব্যযাত্রা আমাদের এক নতুন ধরনের পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়। এই কবিতাগুলো পাঠের জন্য পাঠকের প্রয়োজন হয় কিছুটা ধৈর্য এবং খোলা মন। এটি কেবল উপভোগের বিষয় নয়, বরং এটি চিন্তার খোরাক জোগায়। উত্তরাধুনিক কবিতা বুঝতে হলে এর ভাঙা বাইনারিগুলোকে জোড়া লাগাতে হয় এবং বহুত্ববাদী অর্থকে আলিঙ্গন করতে হয়। এটি পাঠকের জন্য এক নতুন ধরনের মানসিক অনুশীলন। উত্তরাধুনিক কবিতা পড়ার জন্য আগ্রহ এবং ধৈর্য উভয়ই প্রয়োজন। এটি দ্রুত পড়া বা সহজে বোঝার বিষয় নয়। বরং এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, যেখানে পাঠককে প্রতিটি লাইন ও শব্দের গভীরে গিয়ে ভাবতে হয় এবং অর্থ খুঁজে পেতে হয়।
০
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের তরুণ পাঠক কি এই ভার নেবে? না, অনেকেই পারবে না। তবে এই অক্ষমতা পাঠকের দোষ নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক সাহিত্য শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার একটি সীমাবদ্ধতা। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে আমরা বেশিরভাগই চিরায়ত এবং আধুনিক ধারার কবিতা পড়ে এসেছি, যেখানে কবিতা বোঝার পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট। ফলে, হঠাৎ করে উত্তরাধুনিকতার মতো একটি ভিন্ন ধারার মুখোমুখি হলে পাঠকের পক্ষে মানিয়ে নেওয়া কঠিন বোধ হবেই। যদি পাঠক এসব কবিতা বুঝতে তার দৃষ্টি প্রসারিত না করে, তাহলে এই ধরনের কবিতার ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়াবে এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু এর উত্তর কেবল নৈরাশ্যবাদীতায় নেই।
০
সত্য যে, উত্তরাধুনিক কবিতার পাঠক সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক কম। এটি একটি বিশেষায়িত পাঠকগোষ্ঠীর জন্য রচিত হয়, যারা সাহিত্যের প্রচলিত কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আগ্রহী। সব পাঠককে এই ধরনের কবিতা পড়তে হবে বা বুঝতে হবে, এমনটি আশা করা অবাস্তব। সাহিত্য কোনো স্থির বিষয় নয়, এটি প্রতিনিয়ত বিকশিত হয়। আধুনিকতা যেমন রোমান্টিকতাকে পেছনে ফেলে এসেছিল, তেমনি উত্তরাধুনিকতাও আধুনিকতার সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে মুক্তি চায়। এই ধারাটি সাহিত্যের মূল স্রোতে না থাকলেও, এটি এক ধরনের বিকল্প ভাবনা এবং চেতনার জন্ম দেয়। এটি সাহিত্যের শরীরকে সচল ও প্রাণবন্ত রাখতে সাহায্য করে।
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,নজরুলের রহস্য,পড়ুন এখানে
লিসেল মুলারের অনুদিত কবিতা পড়ুন এখানে
প্রেমের কবিতা বা সহজবোধ্য কবিতা নিশ্চয়ই সেই সব পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা অল্পতে বিনোদন পেতে চান, কিংবা সামান্যের মধ্যে সময়ের অবসাদের নিস্তার খোঁজেন। কিন্তু কঠিন বা জটিল কবিতাগুলোও অপরিহার্য ভাবে গভীর চিন্তার খোরাক। এই ধরনের কবিতা পাঠককে প্রচলিত ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে চিন্তাকে প্রসারিত করে, মনের কসরত করায়, যা পাঠকের চিন্তাশক্তিকে শাণিত করে।
০
বিজ্ঞাপন
উত্তরাধুনিক কবিতাগুলো আমাদের সময়ের জটিলতা, ভাঙন এবং বিচ্ছিন্নতাকে ধারণ করে। সমাজের এই দিকগুলো কেবল প্রেমের কবিতা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। এই কঠিন কবিতাগুলো আসলে আমাদের সময়েরই প্রতিচ্ছবি। আমার আলোচনাও কিন্তু উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে অজানা পাঠকের সঙ্গে যা কঠিন কবিতাগুলোকে নিয়েই। এই কবিতাগুলো আলোচনার জন্ম দেয়, সাহিত্যের প্রাণবন্ততা বজায় রাখে। যদি পাঠকের সংখ্যা কমেও যায়, তাহলেও এই ধরনের কবিতার গুরুত্ব হারায় না। কারণ, সাহিত্যের ইতিহাস স্বল্পসংখ্যক পাঠকের হাত ধরেই এগিয়েছে। সুতরাং, পাঠককে সরিয়ে দেবে না, বরং নতুন ধরনের পাঠক তৈরি করবে।
০
হয়ত এক সময় সামগ্রিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে এর প্রভাব লক্ষণীয় হযে উঠেবে। এই ধারা থেকে জন্ম নেওয়া নতুন ভাষা, নতুন ভাবনা এবং নতুন লেখার শৈলী ইতোমধ্যে মূলধারার সাহিত্যেও ধীরে ধীরে প্রবেশ করা শুরু করেছে। কিছু পাঠক হলেও এই ধরনের কবিতা নিয়ে ভাবছেন এবং এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছেন। যে কোনো কবিতার ভবিষ্যৎ পাঠকের আগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। যদি পাঠক এই কবিতা নিয়ে আলোচনা করে, তাহলেই তার বোঝার ক্ষমতা প্রসারিত হয়। যদি কোনো পাঠক আগ্রহে কবিতাগুলো বোঝার জন্য অন্য কোনো সাহিত্যকর্মের মুখোমুখি হয়ে তার অর্থ বা ব্যাখ্যা জানতে চায়, তখন সেটি সাহিত্য এবং পাঠকের মধ্যে এক নতুন ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে। এটি প্রমাণ করে যে, কবিতাটি পাঠককে ভাবাতে পেরেছে এবং তার মনে নতুন প্রশ্ন জাগাতে পেরেছে।
০
সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা গেছে, সব সময় সব পাঠক সব ধরনের সাহিত্য পছন্দ করেনি। একসময় মানুষেরা গদ্যের চেয়ে পদ্য বেশি পড়ত। যখন উপন্যাস এলো, তখন অনেকে নাক সিটকেছিল। সময়ের সাথে সাথে রুচির পরিবর্তন হয়। কবিতাও সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়। আধুনিকতার যুগে যেমন জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসু নতুন ধরনের কবিতা লিখেছেন, তখন অনেকে তাদের কবিতা বুঝতে পারেননি,নাক সিটকেছে। তবুও তারা থেমে থাকেননি, কারণ তারা জানতেন, তাদের কবিতা বোঝার মতো পাঠকগোষ্ঠী একদিন তৈরি হবে। আজ আমরা জীবনানন্দকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গণ্য করি। অথচ কবির কালে কবি ছিলেন অগ্রাহ্যের মধ্যে।
শেষে বলা যায় আমাদের এই ধরনের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ না হয়ে বরং একে সাহিত্যের বিবর্তনের একটি অনিবার্য অংশ হিসেবে নিলে পাঠকই উপকৃত হবেন।
লেখকঃ
কবি,প্রাবন্ধিক
ঢাকা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks