আমি’ থেকে ‘আমরা’ সাহিত্যচর্চার আত্মমুক্তি ও সমষ্টির দায়।। জিয়াউদ্দিন লিটন।। article by ziauddin liton-kuasha কুয়াশা

আমি’ থেকে ‘আমরা’ সাহিত্যচর্চার আত্মমুক্তি ও সমষ্টির দায়।। জিয়াউদ্দিন লিটন।। article by ziauddin liton-kuasha কুয়াশা



প্রবন্ধ

আমি’ থেকে ‘আমরা’
 সাহিত্যচর্চার আত্মমুক্তি ও সমষ্টির দায়

  জিয়াউদ্দিন লিটন


সাহিত্যচর্চা একটি গভীর আত্মসাধনা, যেখানে ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও বোধ থেকে সমষ্টিকে ধারণ করার প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই সাধনা অনেকাংশেই রূপ নিচ্ছে আত্মপ্রচারে। লেখক নিজেকে বড় করে দেখানোর জন্য “আমি” ও “আমার” জাল বুনছেন, আর তাতে সাহিত্য পরিণত হচ্ছে এক আত্মতুষ্টির আয়নায়। এখানে কবি বা লেখক যেন কেবল নিজের জন্য লিখছেন, পাঠকের জন্য নয়—সমষ্টির জন্য নয়।

এই প্রবণতা সাহিত্যচর্চার মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বাংলা সাহিত্যে আমরা দেখি—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত—তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে রূপান্তর করেছেন সামষ্টিক উপলব্ধিতে। নজরুল “আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত” বললেও সে উচ্চারণ ছিল জাতির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর "আমি"কে আত্মদর্শনের দর্পণে শাণিত করলেও, তা অবশেষে পৌঁছে যায় মানবজাতির সার্বিক সত্যে—"আমার মুক্তি আলোয় আলোয়..."


আজকের সাহিত্য-চর্চার ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—সাহিত্য হয়ে উঠছে একরকম ব্যক্তিপরিচয়ের উপস্থাপনমঞ্চ। কারও একাধিক কবিতা, গল্প বা রচনাসঙ্কলন প্রকাশ পেলেই তিনি নিজেকে একজন ‘প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। অনেক সময় সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায় স্ট্যাটাসে বন্দি গৌরব, ফেসবুক লাইভে প্রদর্শিত আবেগ, কিংবা মোড়ক উন্মোচনের ছকবাঁধা আয়োজনে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দ্বারা ‘মূল্যায়িত’ এক আনুষ্ঠানিক উচ্চারণে।

এই ধারা সাহিত্যিকতা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক প্রবণতা—যেখানে সৃজনের চেয়ে প্রদর্শন বেশি গুরুত্ব পায়। এক্ষেত্রে সাহিত্য হয়ে পড়ে আত্ম-প্রতিষ্ঠার মাধ্যম, আত্মমগ্ন উল্লাসের বাহন। বিষয়টি কেবল লেখকের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একটি প্রজন্মের সাহিত্যচর্চাকে প্রগতিশীল চিন্তা ও গভীর পাঠচর্চা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।


সাহিত্য যদি কেবল “কে লিখল” প্রশ্নে আটকে থাকে, “কেন ও কাদের জন্য লিখল”—সেই প্রশ্নটি তলিয়ে যায়। এই জায়গা থেকেই আত্মচর্চার মধ্যে ‘আমরা’ ভাবনার অনুপস্থিতি তৈরি হয়। ফলে সাহিত্য একটি মানবিক ঐক্য নয়, বরং একেকটি বিচ্ছিন্ন ‘আমি’র উচ্চারণে পরিণত হয়।


সাহিত্যিকের ভূমিকা আত্মপ্রকাশ নয়, বরং অভিনব ভাবে ‘অপর’-এর হয়ে কথা বলা। লেখক যদি শুধু নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, তবে তিনি একজন আত্মজীবনীকার। কিন্তু সাহিত্যিক তখনই হয়ে ওঠেন সমাজ-সংবেদী, যখন তিনি এক শিশুর কান্না, এক কৃষকের ক্লান্তি, এক প্রান্তিক নারীর অশ্রু—এ সব কিছু নিজের বেদনার মতো ধারণ করেন। তখন লেখকের "আমি" হয়ে ওঠে "আমরা"।


তাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন তাঁর “Dialogic Imagination” এ যে বহুস্বরতার কথা বলেন, সেখানে লেখকের কণ্ঠস্বর কেবল একক নয়, বরং বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক। সেই বহুস্বরতা “আমি”র একচেটিয়াতা ভেঙে দিয়ে “আমরা”র জাগরণ ঘটায়। এই “আমরা” হলো শোষিত, অবহেলিত, নীরব মানুষের কণ্ঠস্বর—যা সাহিত্যে প্রতিফলিত হলে তা হয়ে ওঠে সংগ্রামের ভাষ্য।



তাই সাহিত্যচর্চায় আত্মবিলাসের মোহ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা "আমার লেখা", "আমার কণ্ঠ", "আমার ভাবনা" বলেই ক্লান্ত হন, তারা ভুলে যান সাহিত্য কখনও একার হয় না। এটি পাঠক-লেখকের এক যৌথ নির্মাণ। সাহিত্যে ‘আমি’র অস্তিত্ব তখনই টিকে থাকে, যখন তা সমষ্টির আয়নায় প্রতিফলিত হয়। আত্মপ্রতিষ্ঠার পিপাসা যদি অন্যের অনুভবকে গ্রাস করে, তবে তা সাহিত্য নয়, তা এক ধরণের আত্ম-অভিনয়।


সাহিত্য আমাদের শেখায়, আত্মকেন্দ্রিকতা নয়—সহজতা, সংযোগ ও সমবেদনা। তাই লেখকের দায়িত্ব কেবল সৃজন নয়, আত্মমুক্তিও। "আমি কী বললাম" নয়, বরং "আমরা কী শুনতে পেলাম"—এই প্রশ্নটিই সাহিত্যকে সত্যিকারভাবে মহৎ করে তোলে। আসুন, আমরা ‘আমার কবিতা’ নয়, আমার গল্প নয়, আমার প্রবন্ধ নয়,  ‘আমাদের  কথা' লিখি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন