গুচ্ছকবিতা
গোলাম কিবরিয়া পিনু
হরমোন
এই পরিবেশ-এই প্রতিবেশে
আমি যেন এক দূরের মানুষ-
মনে হয় ভিনগ্রহ থেকে এই ধরাধামে এসেছি,
সবকিছু অপরিচিত ও নতুন!
ভিন্ন ভিন্ন সংকেত নিয়ে চলতে হচ্ছে
মিথস্ক্রিয়ায় আমার হরমোনও পরিবর্তন হচ্ছে-
আমার কণ্ঠস্বরও চিনতে পারছে না
মা ও বাবা, ভাই ও বোন, বন্ধুরা!
আমি নিজে নিজের মত হাঁটতে পারছি না
ট্রফিক পুলিশ বলে দিচ্ছে-
ওপথে রিক্সায় চড়ে যেতে পারবো না!
এমনকি হেঁটেও যেতে পারবো না!
বড় সেতুতে তো গাড়ি ছাড়া উঠতেই পারবো না!
গাঁইগুঁই করে গাইবান্ধায় পর্যন্ত যেতে পারবো না!
নিজের ইচ্ছেমতো স্পর্শ ও ছোঁয়ার শক্তি হারিয়ে
ভূতগ্রস্ত হয়ে ভূতের রাজত্বে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাচ্ছি,
নিজের আশ্রমে-নিজের আশ্রয় নেই!
শুধু মার্কেটের কনজিউমার হয়ে-
এ-মার্কেটে ও-মার্কেটে ঘুরছি,
নিজে পতুল হয়ে-সেক্সডলের দিকে নজর রাখছি!
সঙ্গীতের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতে পারছিনে!
কুঞ্জঘর কুঞ্জতলে নেই
সঙ্কোচে সঙ্কোচে
সংকুচিত হয়ে পড়ছি!
নড়ছি কি এখন? নড়ছি না!
ক্ষয় ও খর্বতা নিয়ে ছোট হয়ে যাই!
একমাত্রিক ধাতুতে গড়ে তুলছি যে আশাটুকু
তাও থাকছে না!
কেটলির গরম পানিও-
বাষ্প হয়ে শূন্য হয়ে যাচ্ছে!
কেড়–য়াল দাঁড় টানতে পারছে না,
নদী পার হবো কীভাবে এখন?
খচ্চরদের উৎপাতে-
খচখচানিতে কষ্ট বাড়ছে!
গবাদি পশুর খুরের নিচে শুধু গিরগিটি নয়,
-আমিও পড়েছি!
সমতটে সমব্যথী হওয়ার লোকও থাকছে না
সমতা সদৃশ্য হয়ে দেখা যাচ্ছে না!
কোনো কিছুর পূর্ণতা নেই, পরিণতি নেই-
বড়ত্ব থাকছে না!
সন্ধিক্ষণে সন্ধিক্ষণে কৃশে হয়ে যাই
বাদছাঁদ ও কাটাকুটিতে কুঁকড়ে যাই!
কুঞ্জঘর কুঞ্জতলে থাকছে না!
ঝুমকোজবার বাগান
সে কতদূর যায়-
আমি কতদূর যাবো?
তা আমিও দেখতে চাই!
সে ভেবেছে-তার উঠানে পা না রাখলে
আমি ঝুমকোজবার বাগানে
পা রাখতে পারবো না!
সে ভেবেছে-তার মঞ্চে জায়গা না হলে
আমাকে আর কেউ দেখবে না
আমার কথা কেউ শুনবে না!
তাদেরই মঞ্চ-একমাত্র মঞ্চ নয়!
মুরলী বাজাতে বাজাতে-তা তারা ভুলে যাচ্ছে!
এইযে তারা আমাকে কতভাবে
আটকাতে চাইছে-
কত রকমের বাঁধ!
আমার জলের শক্তি ও অশ্রুতে তা ভেসে যাবে!
ও হে, আমার শক্তিকে শুধু আমি টের পাইনি,
আমার শক্তিকে আরও কতজন অভিনন্দিত করেছে,
তা তুমি জানতে পারোনি?
কে কাকে কতক্ষণ আটকে রাখে?
ধোঁয়ার ভেতর-ভূকম্পনের ভেতর?
ধোঁয়া ও ভূকম্পন-একসময় শেষ হয়ে যায়!
মূল্য ও যোগ্যতা-তোমার দ্বারাই নিরূপণ হবে না
আমার থাকা না থাকা-অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব,
তোমার ওপর নির্ভর করে না!
আমার হাতেও আয়ুধ রয়েছে-
আমিও আমার শোণিতে বেঁচে আছি।
আমার ললাটে মেঘছায়া থাকলেও-
আমিও তো অতসী পাথর,
আমারও গায়ে কিরণ লাগে।
লোমশ পায়ে আনোট
ফুটবল মাঠে ঢুকে পড়ছে
ক্রিকেট খেলোয়াড়রা!
ক্রিকেট মাঠ বানিয়ে ফেলবে নাকি?
হাডুডু খেলোয়াড়রাও ঢুকে পড়ছে!
কিন্তু সাঁতারুরেরা কোন মহাসাগরের পার থেকে এসে
ফুটবল মাঠে জড়ো হতে চাইছে কেন?
ফুটবল মাঠে তো পুকুর ও জল নেই!
মাঠটির চারিত্র্য বদলিয়ে
আদাজল খেয়ে আধাখেঁচড়া করে
আত্তীকরণ করতে চাইছে তারা!
কী আধিভৌতিক আধিপত্য!
তাদের লোমশ পায়ে আনোট পরিয়ে দিচ্ছি!
ও ভাবী ও ভাইজান-
কী ভাবোচ্ছাসে ভেসে যাচ্ছেন?
তোষামোদ
নিজের প্যাচে নিজে পড়ে যাচ্ছি!
এতগুলো দেওয়াল দিয়ে
নিজেকে ঘিরে রেখেছি,
কীভাবে নিজেকে মুক্ত মানুষ বলি!
আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি?
আমি আমাকে চিনতে পাচ্ছি?
আমার পতন ঠেকাতে কোনো ঠেকনা দিতে পারিনি!
বদনার জল দিয়ে বদনাম ধুয়েমুছে ফেলতে পারিনি!
বারদুয়ারি ঘরে গিয়ে
বারবনিতার নাচ দেখতে দেখতে সময় চলে গেল!
নিজের নদীর মোহনায় অবস্থিত
বদ্বীপে দীপ জ্বালাতে পারলাম না!
নিজেকে এতটা তোষামোদ করেছি যে
তোষক ও বালিশের সখ্য নিয়ে শুধু থাকলাম,
বায়ু পরিবর্তন আর হলো না!
জগাখিচুড়ি
রাত ঘুমিয়ে থাকার কথা
রাত ঘুমাচ্ছে না!
দিন জেগে থাকার কথা
দিন ঘুমিয়ে পড়ছে!
কী অরাজকতা
সময়ের ঘড়িতে!
কাঁটাচুয়ার গায়ে কাঁটা নেই
বাঘের মাঢ়িতে শক্ত দাঁত নেই
কী উলটপালট!
পরিবর্তনের হাওয়া!
চোখ থেকে ক্রন্দনের জল পড়ে না
ছড়ানো কাঁদানে গ্যাসের কারণে
অস্থিরতায় চোখের জল!
কী আলুথালু অবস্থা
ঘরের বাইরে!
ঘরণি ঘরে থাকতে পারছে না!
শীত আটকাতে পারছে না
জীর্ণ হয়ে যাওয়া কাঁথা!
কী আলুথালু অবস্থা
ঘরের ভেতর!
মানুষ জাগ্রত হয়ে ছুটে যাচ্ছে জঙ্গলে!
জংলী হয়ে যদি জঙ্গলে থেকে যেত
তবুও ভালো ছিল!
কিন্তু তারা জঙ্গল উধাও করে দজ্জাল হয়ে উঠছে!
কী খেই হারানো অবস্থা!
জাঁহাবাজ হয়ে জাহাজে কোথায় না যাচ্ছে!
জগাখিচুড়ি হয়ে খিচুড়িও খাচ্ছে!
প্রান্তিক
প্রান্ত থেকে প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছি!
যে প্রান্তে সূর্যমুখী ফুটেছিল,
সেই প্রান্ত খসে যাচ্ছে!
পরস্পর সংলগ্ন থেকে-
জঙ্গলে ছাওয়া গাছপালা নিয়ে
বছরের পর বছর যে লগ্ন তৈরি করেছিলাম,
এক পশলা শিলাবৃষ্টির পর-
তা এখন ভগ্নস্তূপ!
ভগ্নহৃদয় নিয়ে ঠুনকো হয়ে গেলাম!
কৃষিযোগ্য জমি হাতছাড়া হয়ে গেল
এখন সেখানে মদ চোলাইয়ের কারখানা!
মদবিক্রেতারা নেশায় নেশায়
আমাকেও বৃন্তহীন ও বাস্তুচ্যূত করেছে!
ইচ্ছেশক্তি
যিনি নিজের ভেতর বিপ্লব ঘটাতে পারলেন না
তিনি নিজে বিপ্লবী পোশাক পরে আছেন!
এঁটো খেয়ে ইতরামি হবে
বিপ্লব হবে না!
এঁটেল মাটিতে লাঙল চালাতে হলে
পায়ে জোর লাগে,
বন্ধ দোর খুলতে হলে
হাতে জোর লাগে!
নিজের বোতলে নিজেকে আটকে রেখে
নিজেকে মুক্ত করতে পারোনি,
অন্যকে কীভাবে মুক্ত করবে?
ইলিশ মাছ ধরতে হলে-
পদ্মার ঢেউয়ের ভেতর থাকতে হয়,
অনুদাস হলে ইচ্ছেশক্তি-
হাত চুলকাতে চুলকাতে শেষ হয়ে যাবে!
নিজের কাছে
নিজের কাছে নিজে স্পষ্ট হও
ভেক ধরে নেক নজরে আর কত থাকবে?
নিজের কাছে কতটুুকু সৎ থাকো?
কুক্কটও ডাকে ভোরবেলায়
শিয়ালের ডাক নকল করে!
ছিদ্রানুসন্ধানী হয়ে ওঠ-
নিজের ছিদ্র দেখতে পারো না!
নিজের কাছে নিজে কতটুকু সৎ থাকো?
আত্মপ্রতারণা প্রতারণার পরগণা বাড়িয়ে তুলছে!
দেখো, বেলফুল ফুটে আছে
বেলগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই!
দেখো, সজনেফুল ফুটে আছে
সজনেগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই!
দেখো, জুঁইফুল ফুটে আছে
জুঁইগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই!
তুমি যে কখন কী হয়ে ফুটে থাকো!
যার সঙ্গে রাতবেলায় একবিছানায় ঘুমাও,
সে-ও সকালে উঠে তোমাকে চিনতে পারে না!
আত্মনাশ
নদীর ওপারে যাই
খাল কেটে ডেকে আনি কুমির,
নদীতে নদীতে!
নদীরও বুক কাঁপে! আমাদের কাঁপে না?
কুমির ডাঙ্গায় ওঠে
কোন্ চন্দ্রপতঙ্গ পথ দেখায় কুমিরকে?
পথিমধ্যে এসে পড়ে
চতুস্পদও দখল নেবে?
যত্রতত্র হাঁটবে?
তরুলতা ও শাখা, ফুল ও কমল
তছনছ হয়ে যাবে?
নেড়া ও নেড়িকুত্তা পথ দেখাচ্ছে,
ওদের দু’জনের কেশ নেই-কেশ মু-িত!
ক’দিন পর-আমরাও হবো-বেশ মু-িত!
লেজুড়ে হলেও রক্ষা নেই-লেজের বাড়িতে,
বাড়ি ছাড়া হবো!
কূল ও কুল রক্ষা হবে না!
কুহেলিকা ছড়িয়ে ছড়িয়ে-
কোন্ কুলাঙ্গার কুমির ডেকে আনে?
নিজের পায়ে কুড়াল মারার সর্বনাশ
এ-যেন রক্ষাকবচহীন আত্মনাশ!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks