গল্প।। কেতাবি বেগম।। এম এ ওয়াজেদ।। strory by m a wazed-কুয়াশা



গল্পঃ

কেতাবি বেগম
এম এ ওয়াজেদ




দু'দিন হলো কেতাবি বেগম মারা গেছে। গতকাল তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কেতাবি বেগমের স্বামী আদর আলী দশ বছর আগে শনিবার সকালে মারা যায় । তাদের দাম্পত্য জীবন একান্ন বছর সাত মাস একুশ দিনের । দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান রজব আলী। আদর আলী ও কেতাবি বেগম তিন শতাংশ জমি কিনে সে জমির ওপর একটা শোয়ার ঘর , খড়ের ছাউনি দিয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে আসছিলো ।

              কেতাবি বেগমের বয়স যখন নয় , তখন তার পিতা অভাবের কারণে কাজের মেয়ে হিসেবে গ্ৰামের মাতব্বর রহিমুদ্দি মণ্ডলের বাড়িতে তাকে রেখে আসে । প্রথম প্রথম সারাদিন কাজ শেষে কেতাবি বেগম পিতার বাড়িতে রাতে ঘুমাতো । খুব ভোরে আবার চলে যেতো । এগারো বছর বয়স হতে এখন আর পিতার বাড়িতে না ঘুমিয়ে মণ্ডলের বাড়িতে একা ঘুমায় । প্রথমে ভয় করলেও এখন একাকি ঘুমাতে ভয় করে না। 

               কেতাবি বেগমের পনেরো বছর বয়সে তার পিতা মাতা তিন দিন আগে পিছে মারা যায়। তার পিতার নিজ মালিকানাধীন দুই শতাংশ জমিতে একটা বাড়ি ছিলো। পিতৃ-মাতৃহীন কেতাবি বেগমের জীবন নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। কেতাবি বেগমের জন্মের দু'বছর পূর্বে একমাত্র ভাই কেরামুদ্দি আলী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মূর্খ ছিলো কেতাবি বেগমের পিতা ও মাতা । জীবন ও জগত সংসারের সহজাত জিজ্ঞাসা তাদের মনে উদয় হতো কী না তা নিয়ে কোনো দরদি মন হয়তো এতদিনে গবেষণা করছে , তবে সামাজিক বৈষম্যের দুঃস্বপ্নতাড়িত ভয়ার্ত মুখগুলো রাষ্ট্রীয় বন্টনগুলো আগেই খেয়ে ফেলেছে । 

জিল্লুর রহমান শুভ্র'র ভিন্ন স্বাদের কবিতা পড়ুন এখানে
ওপার বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন বসুর কবিতা পড়ুন ক্লিক
ওপারের কবি তৈমুর খানের কবিতা পড়ুন এখানে


                 অসহায়া কেতাবি বেগমের চোখের কান্না থামেনা। কান্নার সাথে অভিমান, অভিযোগ ও অভিশাপ ঝরে পড়ে। রহিমুদ্দি মণ্ডলের স্ত্রী কেতাবি বেগমের দুঃসময়ে সান্ত্বনা দেয়। কেতাবি বেগম জানে মানুষের জীবন পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস মেনে চলে না। তার মাথার ওপর ছাদ হয়ে এতো দিন পিতা মাতা ছিলেন । এখন থেকে সে কার কাছে মনের কথা খুলে বলবে ? কে তার কথা শোনবে ? কোনো কোনো মানুষের জীবন হঠাৎ কেনো জানি অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে যায় , এর উত্তর কে দিবে ? 

               কেতাবি বেগমের বিয়ে ঠিক হয়েছে । পাত্রের নাম আদর আলী । এতিম ও দিনমজুর। আদর আলী গত দশ বছর ধরে রহিমুদ্দি মণ্ডলের বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। রহিমুদ্দি মণ্ডলের স্ত্রী ঘটক সেজে নিজ বাড়িতে বিয়ের বন্দোবস্ত করে। এ বিয়েতে কোনো যৌতুক ছিলো না। মোহর ধার্য হয় এক হাজার একশো টাকা । আদর আলী একশো টাকা নগদ মোহর পরিশোধ করে। সেটাও রহিমুদ্দি মণ্ডলের স্ত্রীর কাছ থেকে ধার নেয়া। বিয়ের পর তাদের বাসরঘর কেতাবি বেগমের পিতার বাড়িতে সম্পন্ন হয় । বাসর রাতে কেতাবি বেগম তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে অনেক অনেক কথা শেয়ার করে । কেতাবি বেগম স্বামী আদর আলীকে বলে যে তারা একটানা এক বছর রহিমুদ্দি মণ্ডলের বাড়িতে কাজ করে যে টাকা পাবে , সে টাকা বছর শেষে একবারই নিয়ে আর কাজ করবে না। দুজনে মিলে কাছাকাছি দেড় লাখ টাকা পেয়ে আদর আলী একটা চার্জার রিকশা কিনবে । বাকি টাকা দিয়ে কয়েকটা ছাগল কিনে কেতাবি বেগম নিজে লালন পালন করে স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে ।

               
      আদর আলী এখন চার্জার রিকশা চালক। ইনকাম মোটামুটি ভালো। সংসারে খরচ করেও প্রতিদিন হাতে নগদ টাকা জমা হয় । ওদিকে কেতাবি বেগমের আদর যত্নে দুটো ছাগল বছর শেষে বৃদ্ধি পেয়ে সংখ্যায় ছ'টিতে দাঁড়ায় । কেতাবি বেগম বিয়ের এক বছর ছয় মাস পরে গর্ভবতী হয়ে পড়ে । নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে আদর আলী ও কেতাবি বেগমের হৃদয় মন্দিরে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। ছেলে বা মেয়ে হোক তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে বলে তারা প্রতিজ্ঞা করে ।

               সেদিন ছিলো শনিবার । আষাঢ় মাস। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। কেতাবি বেগমের ছেলে হয়েছে তিন মাস হলো। বুকের দুধ খাওয়ানো শেষ হলে কেতাবি বেগম বাচ্চাকে ঘুম পাড়ায়। বৃষ্টির কারণে আদর আলী বাড়িতে অবস্থান করছিলো। হঠাৎ দেখে দরজার সামনে রহিমুদ্দি মণ্ডল আরো পাঁচজন লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে থানা পুলিশের একজন এসআই ও সাথে কয়েকজন কনস্টেবল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। গ্ৰামের আরো লোকজন হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেলে রহিমুদ্দি মণ্ডলের সাথে আসা লোকজন নিজেদের কোর্টের লোক পরিচয় দিয়ে কেতাবি বেগম ও তার স্বামীকে বাড়ি খালি করতে বলে এবং সে মর্মে কোর্টের জারি পরোয়ানা আছে বলে প্রকাশ করে।

                 উপস্থিত সবার সামনে রহিমুদ্দি মণ্ডল প্রকাশ করে যে, কেতাবি বেগমের পিতা মৃত্যুর এক বছর আগে এ জমি টাকা নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করে দিয়ে গেছে। সে দলিল দিয়ে উচ্ছেদের মামলা করে কোর্ট হতে ডিক্রি পেয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমির দখল না ছাড়ায় কোর্ট ডিক্রি জারি দিয়েছে। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বৃষ্টি থেমে গেলে কেতাবি বেগম কোলের বাচ্চার জন্য এক মাসের ভাড়া চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ।

ইমদাদুল হক মিলনের নুরজাহান উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধঃ পড়ুন
চানক্য বাড়ৈ এর কবিতা পড়ুন এই লিংক এ
বিনয় মজুদারকে উৎসর্গিত পিয়াস মজিদের কবিতা পড়ুন এখানে
poem by p.francis click here
কবি আমিনুল ইসলাম মুল্যায়ন প্রবন্ধ পড়ুন এখানে 
             
শনিবারের পরের সোমবার আদর আলী কোর্টে গিয়ে মামলার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, রহিমুদ্দি মণ্ডল উচ্ছেদের যে মামলা দায়ের করেছিলো, তার সমন কেতাবি বেগমকে না দিয়ে জারিকারকের সাথে যোগসাজশ করে জারি দেখায় । মামলার আরজিতে রহিমুদ্দি মণ্ডল কেতাবি বেগমের পিতাকে দাতা হিসেবে যে দলিলের বর্ণনা দিয়েছে, তার পিতা সে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়নি। রহিমুদ্দি মণ্ডল যেবার মেম্বার হয়েছিলো, বয়স্ক ভাতা দেয়ার নাম করে কেতাবি বেগমের পিতার বাড়িতে এসে কিছু কাগজপত্রে সই নিয়েছিলো। 

               কেতাবি বেগমের ছেলে রজব আলী মেধাবী ছাত্র। সে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে। একসময় এডভোকেট হিসেবে বারে যোগদান করে। সে রহিমুদ্দি মণ্ডলের ডিক্রিপ্রাপ্তনমামলার রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।সসে মামলার সমন হাতে পেয়ে রহিমুদ্দি মণ্ডল অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে জানে দলিল জাল। অপরদিকে, পূর্বের মামলার সমন মিথ্যাভাবে জারি করা হয়েছে। তার অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলে । চূড়ান্ত শুনানির দিন রহিমুদ্দি মণ্ডল হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় । 

             কেতাবি বেগম ও তার স্বামী কবরে শুয়ে আছে। রজব আলী মায়ের কবরে গিয়ে কাঁদতে থাকে। ফিরে পাওয়া জমিতে রজব আলী একটা নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করে অক্ষর জ্ঞানহীন লোকজনের জন্য দান করে । রজব আলী অধ্যায়নে জানতে পারে, সমাজে হাজারো রহিমুদ্দি মণ্ডল অবশেষে পরাজিত হয় , কেতাবি বেগমেরা জয়ী হয়। 

--

with thanks & regards____

image

দ্বীপ সরকার

editor of kuasha

+88001719751792

kuasha.mag@gamil.com

https://mkuasha.blogspot.com/

facebook

twitter

linkedin



Post a Comment

Thanks

নবীনতর পূর্বতন