নজরুলে ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রবন্ধ।।নজরুলের প্রমীলা ।।চৌধুরী শামসুল আরেফীন ।। কুয়াশা article of kazi nazrul Islam

নজরুলে ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রবন্ধ।।নজরুলের প্রমীলা ।।চৌধুরী শামসুল আরেফীন ।। কুয়াশা article of kazi nazrul Islam



নজরুলের প্রমীলা 

চৌধুরী শামসুল আরেফীন 


লেখকের কবিতায়, গানে, গল্পে বা উপন্যাসে নারীর প্রভাব নতুন কিছু নয়। বিশ্বের প্রায় সকল সাহিত্যিকের সাহিত্যে নারীর প্রভাব কমবেশি লক্ষ্যনীয়। তবে প্রভাব বিস্তারকারীণীর চেয়ে প্রেরণাদাত্রীর সংখ্যা খুবই কম হয়। একইভাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের পিছনে বহু নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যে এক অনন্য অনুপ্রেরণাদাত্রী ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা দেবী। নজরুল যদি কোন নারীকে সবচেয়ে বেশী ভালোবেসে থাকেন, তবে তিনি প্রমীলা দেবী। 
প্রমীলার আসল নাম আশালতা সেনগুপ্ত- ডাকনাম দোলনা। তবে আদর করে অনেকে তাঁকে দুলি নামে ডাকতেন। 

প্রমীলা দেবী ছিলেন তাঁর বাবার  দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। বাবাকে হারিয়েছিলেন শৈশবেই। কাকার সংসারে বেড়ে উঠা তাঁর। কুমিল্লায় যখন রাজনৈতিক মিছিল বেরিয়েছে, তখন কিশোরী দুলি তাতেও অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। সেই সময় এক চৈত্র মাসের শেষে কান্দিরপাড়ে দুলিদের বাড়িতে এসেছিলেন নজরুল। সখ্যতা গড়েন দুলির পরিবারের সাথে। দুলি'র মা গিরিবালা দেবীকে তিনি মা বলে ডাকেন। গিরিবালাও নজরুলকে ছেলের মতো স্নেহ ডোরে বেঁধে নেন। মাত্র ক'দিনের জন্য এসেছিলেন নজরুল কিন্তু সেই ক'দিন বাড়ির হাওয়ায় ঝড় তুলে তিনি আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেলেন দৌলতপুর নামে এক গ্রামে। সেখান থেকে দেড় মাস পরেই খবর এলো- নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়েছে নার্গিসের সাথে। বাড়ির অন্যদের সঙ্গে দুলি (প্রমীলা)ও গিয়েছিলেন বিয়েতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেই রাতে বিয়েটা হয়েই ভেঙে গেলো। তাই নজরুল ভোর হতে না হতেই কান্দিরপাড়ে চলে যান। পরের দিন প্রমীলাও ফিরে আসেন তাঁর বাড়িতে।

এই দুর্ঘটনার প্রচণ্ড আঘাতে নজরুল মুষড়ে পড়েন। কিন্তু সপ্তাহ তিনেক পর কলকাতা থেকে আসা এক বন্ধুর সঙ্গে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। তবে মাস তিনেক পর, অক্টোবর মাসে, নজরুল আবার কান্দিরপাড়ে দুলিদের বাড়ি বেড়াতে আসেন। তখন পাঁচ-ছয় সপ্তাহ ছিলেন। তারপর দুলি (প্রমীলা)দের বাড়িতে নজরুল এসেছিলেন পরের বছর ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। 

নজরুল একদিন তাঁকে একটা কবিতা উপহার দিলেন, যার প্রথম লাইনেই ছিলো-‘হে মোর রানী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।’ এ কথার মানে দুলি বোঝেন, আবার বোঝেন না। এ কি তাঁকেই বলা? সেবার এসে নজরুল কান্দিরপাড়ে ছিলেন প্রায় চার মাস। শেষ দিকে তাই নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দুরা কুৎসা রটাতে আরম্ভ করেন, তাঁকে অপমান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ওদিকে কলকাতা থেকেও কাজের ডাক আসে। তাই মে মাসের শেষে নজরুল কলকাতায় ফিরে যান। ততোদিনে নজরুলের হৃদয় কুঞ্জে দুলি নামের অবুঝ কিশোরী বাসা বাঁধে শক্তভাবে।
.
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নজরুলের সম্পাদিত "ধুমকেতু" পত্রিকায় "আনন্দময়ীর আগমনে" কবিতাটি প্রকাশ হয়। এই কবিতাটি ব্রিটিশ বেনিয়াদের গাত্রদাহের কারণ হয়। কবির খোঁজে পুলিশ পত্রিকা অফিসে অভিযান চালায়। কবি আগে থেকেই সাবধান ছিলেন তাই ধরা পরেননি। তবে সকল সকল সুহৃদদের পরামর্শে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এতোদিনে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। নজরুল কোনভাবে জানতে পারেন দুলিরা বিহারের সমস্তিপুরে এসেছেন তাঁর মামার বাড়িতে। তাই তিনি নভেম্বরের প্রথম দিকে সমস্তিপুরে আসেন। তখন আবার দেখা হয় দুলির সাথে তার মামার বাড়িতে। নজরুলের কাছ থেকে দুলি শুনলেন- তাঁর পেছনে পুলিশ লেগেছে। দুলির হৃদয় আশঙ্কায় দুলে ওঠে। নজরুল তাঁদের (প্রমিলা ও তাঁর মা) সমস্তিপুর থেকে কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে পৌঁছে দিলেন। কিন্তু সেখানে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কবি গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। মামলা হলো- মামলায় তাঁর সাজা হলো এক বছরের। 
.
জেল থেকে ছাড়া পেলেন ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর।
ছাড়া পাবার তিন-চার দিনের মধ্যেই তিনি দুলিকে দেখতে কান্দিরপাড়ে আসেন।
কিন্তু ক'দিন পরই নজরুলের উপর আরেকটা মামলা হয়। তাই কান্দিরপাড়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব হলো না। তাছাড়া বর্ণবাদী হিন্দুরা ঝামেলা করছিলো। তাই দুলি আর তাঁর মাকে সমস্তিপুরে পৌঁছে দিয়ে নজরুল কলকাতায় চলে যান।

নজরুল এবং দুলির বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। এবারও সমস্তিপুর থেকে দুলি(প্রমিলা) আর তাঁর মাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন নজরুল। নজরুল স্ত্রীর দোলনা নাম পাল্টে রাখলেন প্রমীলা নজরুল। 

বিয়ের আগে প্রমীলাকে পার হতে হয়েছিলো দুস্তর সমুদ্র। প্রথমেই ছাড়তে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে, যে পরিবারের আশ্রয়ে তিনি বড় হচ্ছিলেন, যে পরিবারের লোকেরা ছিলেন তাঁর একমাত্র আপনজন। তাছাড়া প্রবল বাঁধা এসেছিল সমাজের তরফ থেকে। কারণ হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে বিয়ে হয় না। তখনকার একাধিক রাজনৈতিক ব্যাক্তি এ বিয়ের প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের এক বাড়িতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ে হতে আইনের বাঁধাও কম ছিলো না। বাঁধা থাকত না যদি প্রমীলা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতেন অথবা তাঁর বয়স অন্তত আঠারো হতো। কিন্তু তাঁর বয়স ছিল ষোলো বছরেরও সপ্তাহ দুয়েক কম। তিনি মুসলমান হতে চাননি, নাকি তাঁর মা গিরিবালা দেবী তা চাননি, নাকি নজরুলই তা চাননি- এ বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। কিন্তু আইনের বাঁধাকে গোঁজামিল দিয়ে অতিক্রম করেন কবি ও তাঁর বন্ধুরা। শেষ পর্যন্ত তাঁদের বিয়ে হয় ইসলামী রীতি অনুযায়ী। নজরুলের বেশির ভাগ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু। কিন্তু বিয়েতে তাঁদের একজনও উপস্থিত ছিলেন না।
বিয়েতে ধুমধাম করার মতো টাকাপয়সা নজরুলের ছিলো না। বিয়ে হয়েছিল মাসুদা রহমান নামের এক বিশিষ্ট নারীর সার্বিক আনুকূল্যে। বিয়ের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ-উৎসবও বলতে গেলে কিছুমাত্র ছিলো না। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দেয় বিয়ের পর। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে বিখ্যাত হলে কী হবে- নজরুলের পক্ষে বাড়ি ভাড়া পাওয়া প্রায় অসম্ভব হলো। আর প্রমীলা ও গিরিবালা দেবী পড়লেন নিজেদের স্বরূপের সংকটে। তাঁরা না মেশার সুযোগ পাচ্ছিলেন হিন্দু পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে, না পারছিলেন মুসলমানদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দে মিশতে।

সংসারের মধ্যে থেকেই তাঁরা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। এই নিঃসঙ্গতা আংশিকভাবে তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারতেন নজরুল যদি ঘরমুখী হতেন। কিন্তু তিনি বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন ঘরের বাইরে। তাঁর জগৎটা ছিল সংসার থেকে অনেক দূরে। তাঁর সময় কাটত আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে, হইচই করে। তাঁর ধারণা ছিল ‘বেলা যাবে আসবে গান গেয়ে আর পান খেয়ে।’ স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার মতো অফুরন্ত সময় কোথায় তাঁর?

শেষ জীবনে পক্ষঘাতগ্রস্থ হয়েছিলেন প্রমীলা দেবী।  রোগ সারানোর জন্য কবি নজরুল কোনো চিকিৎসাই বাদ রাখেননি। প্রমীলার প্রতি নজরুলের কতোটা দরদ ও প্রেম ছিল সে সম্পর্কে অনেক নজরুল গবেষকও অবগত নন। দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, সাধু-সন্ন্যাসীর মন্দির, পীর-ফকির, তাবিজ-কবজ, মাবার, পানিপড়া এসব নিয়েও কবি প্রমীলাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। 

কবি জসীম উদদীনের বিবরণী থেকে জানা যায় কোন এক দরবেশের পরামর্শে নজরুল শত বছরের কচুরীপানা ভর্তি এক পঁচাডোবায় সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শরীর নিমজ্জিত রেখে অতঃপর দরবেশের তাবিজ নিয়ে প্রমীলাকে দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রমীলা দেবীও এই অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও যতদিন পেরেছেন নিজ হাতে স্বামীকে খাইয়ে দিয়েছেন। কবির ভক্ত ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তিনি একান্ত আপনজনের মতো ব্যবহার করতেন।

১৯৬২ সালের ৩০ জুন মারা যান প্রমীলা। তাঁকে কবর দেয়া হয়  চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে তাঁর কবরের পাশে জায়গাও  রাখা হয়েছিলো নজরুলের জন্য। কিন্তু  তাঁর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি।


তথ্যঋণ|ঃ  বিদ্রোহী রণক্লান্ত (নজরুল জীবনী)/ গোলাম মুরশিদ
নজরুল জীবনে নার্গিস/ এম এ ওয়াহীদ
নিষিদ্ধ নজরুল/ শিশির কর
নজরুল এ লিভিং লিংক/ স্বপন পাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন