কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রবন্ধ।। নজরুলের স্ত্রী ও প্রেমিকা প্রমিলা ।।এস ডি সুব্রত।। kobi kazi nazrul's article by sd subrato.kuasha

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রবন্ধ।। নজরুলের স্ত্রী ও প্রেমিকা প্রমিলা ।।এস ডি সুব্রত।। kobi kazi nazrul's article by sd subrato.kuasha



নজরুলের স্ত্রী ও প্রেমিকা প্রমিলা
এস ডি সুব্রত

        কবি নজরুল ১৯২১ সালের ১৮ জুন বিয়ের রাতে দৌলতপুর থেকে অভিমানে ও ক্ষোভে পালিয়ে  কুমিল্লা বিরজা দেবীর বাড়িতে  চলে যান । সেখানে  গিয়ে অসুস্থ নজরুল অনেকটাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন । তখন সেখানে  তার সেবা করার দায়িত্ব পরে প্রমীলার ওপর। কারণ সে সময় প্রমীলা ছিল ওই বাড়ির মধ্যে সবার বড়। সে কারণেই বিরজা দেবী সব সময় প্রমীলাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। এ সময়টাতে প্রমীলার সঙ্গ কবির মন কাড়ে। যা ধীরে ধীরে প্রণয়ে রূপ নেয়। সুস্থ হয়েই কবি তার বন্ধুবর কাজী মোতাহারের সঙ্গে ৮ জুলাই কলকাতায় ফিরে যান। একই বছর নবেম্বরে প্রমীলার টানে কবি আবার আসেন কুমিল্লায়। সেবার এক মাস ছিলেন তিনি। এ সময়ে কুমিল্লা থাকাকালীন  কবি তাঁর বিখ্যাত দুটি কবিতা ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙার গান’ রচনা করেন। এই বিদ্রোহী কবিতাই কবিকে দেশ জোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এ প্রসঙ্গে নজরুল গবেষক ড. আবুল আজাদ লেখেন “দুই অসামান্য রচনা ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙার গান’ নজরুল ইসলামের অন্তরের গভীর মর্মপীড়ার ফসল। কে এর প্রেরণার উৎস নার্গিস না প্রমীলা? নজরুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্য কর্মে এই দুই নারীর অপরিসীম প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে প্রেমের জগতে অন্তরের গভীর প্রাধান্য পেয়েছিল নার্গিস... পক্ষান্তরে প্রমীলাকে নিয়ে কবি জড়িয়েছেন জীবন জগতে বাস্তবে।” পূণরায় ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে  কবি তৃতীয় বারের মতো কুমিল্লায় আসেন। আর তিন বারের ভ্রমণে কুমিল্লার যুবসমাজ কবিকে বেশ আপন করে নেয়। ১৯২২ সালের নভেম্বরে নজরুল তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধুমকেতু’তে সরকারবিরোধী লেখালেখির কারণে গ্রেফতার হন। ১৯২৩ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর এক বছরের কারাদণ্ড হয়। এ নিয়ে দেশব্যাপী হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ এ সংবাদে ব্যথিত হয়ে তার ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। সে বছরই ১৫ ডিসেম্বর নজরুল বহরমপুর জেল থেকে ছাড়া পান এবং সেখান থেকে সোজা কুমিল্লায় গিয়ে ওঠেন। অবশেষে ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল তাদের বিয়ের দিন ধার্য হয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে অল্প কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের উপস্থিতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ পথ চলার গতি কখনও থামেনি। কবি অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে প্রমীলা তার শেষদিন পর্যন্ত কবির পাশেই ছিলেন। আশালতার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের ব্যাপারটা বিরজা সুন্দরী দেবীও সহজে মেনে নিতে পারেননি। তাই আশালতার বিধবা মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় মেয়ের বিয়ে দেন নজরুলের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজি লেনে সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে। বিয়ের আগে বা পরে স্ত্রীকে নজরুল ইসলাম ধর্মে অন্তরিত করেননি। তাই যে- ইসলামি প্রথা মেনে মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের বিয়ে  হয় নজরুলের ক্ষেত্রে সেই প্রচলিত রীতি পালন করা হয়নি। 'আহলে হাদিস' মতে এক বৈবাহিক চুক্তি অনুসারে নজরুলের বিয়ে হয়। তাতে ধর্ম বদলের প্রয়োজন হয়নি। তবে বিয়ের পর নজরুল স্ত্রীর নতুন নাম দেন প্রমীলা। নজরুলের বিয়ের অনেক আগেই গিরিবালা বিধবা হন। তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরার রাজাদের নায়েব। তখন কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার অন্তর্গত। নজরুলের চিঠিতেই এ তথ্য পাওয়া যায়। খুব সংস্কৃতি সম্পন্ন স্বদেশী মনোভাবাপন্ন পরিবার ছিল তাঁদের। প্রমীলা তাঁদের একমাত্র মেয়ে। সেই মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে গিরিবালা দেবী সংস্কারের বাঁধন ছেরে বেরিয়ে এসেছিলেন। ১৯২৪-এর দগ্ধ কালবেলায়।  প্রেমিকা প্রমীলা তার কাছে রানীর মতো। তিনি নিজেকে সমর্পন করে লিখলেন,

হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে
আমার সময় জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এ হার মানা হার পড়াই তোমার কেশে
ওগো জীবন – দেবী! আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
আজ বিশ্ব –জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে,
বিজয়ীনি! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তুণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন জলে ভেসে ।'

১৯২৩ সালে ডিসেম্বরে কারামুক্ত হয়ে নজরুল আবারও ফেরেন প্রমীলার নীড়ে। নজরুল এই সময়ে প্রমীলার প্রতি নিজের মুগ্ধতা নিয়ে লিখলেন-

"নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায় কে যায় কে যায়
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়।"

নজরুল প্রমিলার  বিবাহে ব্রাহ্ম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এবং ‘প্রবাসী’ পত্রিকা অফিস থেকে প্রধানত : নজরুল বিরোধিতার জন্য সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’ প্রকাশ করা হয়। নজরুলের এই বিবাহ তার মাতৃসমা বিরজা সুন্দরী দেবী অনুমোদন করেননি এবং বীরেন্দ্র কুমার সেন গুপ্ত ‘বৈকালী’ পত্রিকায় ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন।
এ কারণে নজরুল আর কোনদিন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে যাননি। প্রমীলা স্বভাবতই সরল, নম্র-ভদ্র ও বিদুযী ছিলেন। সংসারের হাল ধরতে তার কোন কষ্ট হয়নি। আবার গিরিবালা দেবীও সংসারে যুক্ত হলেন। তিনি সাত্ত্বিক জীবনযাপন করতেন। বিয়ের আগে ও পরে অনেক কবিতায় তিনি প্রমীলার রূপে বর্ণনা তুলে ধরেন, যেমন প্রিয়ার রূপ,দোদুল দুল প্রভৃতি কবিতা। ‘দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন--
মৃণাল - হাত নয়ান - পাত গালের টোল,
চিবুক দোল সকল কাজ করায় ভুল প্রিয়ার মোর কোথায় তুল?
কোথায় তুল? কোথায় তুল ... ... ... ... ...
কাকঁল ক্ষীণ মরাল গ্রীব ভুলায় জড় ভুলায় জীব,
গমন –দোল অতুল তুল্ ।
প্রমীলা নজরুল ৩০ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। তার কোমরের নিজের অংশ অবশ হয়ে যায়। রোগ সারানোর জন্য কবি নজরুল কোনো চিকিৎসাই বাদ রাখেননি। প্রমীলার প্রতি নজরুলের কতটা দরদ ও প্রেম ছিল সে সম্পর্কে অনেক নজরুল গবেষকও অবগত নন। দেব-দেবী, ভূত-প্রেত, সাধু-সন্ন্যাসীর মন্দির, পীর-ফকির, তাবিজ-কবজ, মাবার, পানিপড়া এসব নিয়েও কবি প্রমীলাকে সারিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন।
কবি ভালোবেসে ছিলেন তার প্রেয়সী প্রমীলাকে। তেমনি ভালোবেসেছিলেন প্রমীলার জন্মভূমি ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা তেওতা গ্রামকে। নজরুল তেওতা গ্রামকে নিয়ে ‘ছোট হিটলার’ নামে এক অনবদ্য কবতিা রচনা করেন। কবির দু’ পুত্র সানি ও নিনির মুখ দিয়ে বলা হয়েছে-

মাগো! আমি যুদ্ধে যাবোই নিষেধ কি মা আর মানি
রাত্রিতে রোজ ঘুমের মাঝে ডাকে পোলান্ড-জার্মানি,
ভয় করি না পোলিশদেরে জার্মানির ঐ ভাঁওতাকে
কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামা বাড়ি ‘তেওতা’কে।



লেখকঃ  কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ,নিলয় ১৭৪/৩, পূর্ব নতুন পাড়া সুনামগঞ্জ
০১৭১৬৭৩৮৬৮৮ ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন