তৈমুর খান
ওই তো আবেগ খুলে দাও
আবেগের কলসির কাছে
আমাদের হইহল্লা পিপাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
এভুবনে কত তাপ-অনুতাপ কৃতকর্মের সন্নিধানে
বসবাস করে
আমরা রোজ গার্হস্থ্যের বাগানে সৌজন্য খুঁজতে আসি
কোথাও সৌজন্য আছে আর?
সব সম্পর্কের ভেতর দিয়ে চলে গেছে নীরব কাঁটাতার
শুধু শব্দের প্রজাপতি উড়ে উড়ে আসে
ফুলের ভাষাদের কাছে
এখনো ভাষা আছে, ভাষাদের নিরাময় আছে
ক্লান্তি ও পিপাসায় এখনো শ্রাবণী জলে
ভিজতে চায় উন্মুখ ফসলের মাঠ
দুই হাত দুই দিকে যায়, করতলে ছুঁই শস্যঘ্রাণ
আরও দুই করতল করতল খোঁজে
বেজে ওঠে পিপাসার গান!
শব্দ জানে
এই শোকতাপ সতত শূন্যতা
শব্দে রাখি, শব্দের ভেতর ঘুমায়
নিঃশব্দ কাতরতা
একটি যুগের ঢেউ, দিনযাপনের মুহূর্ত
যে ইতিহাস লেখা হয় না
যে ভূগোলে শুধুই দেহবাদ
সব সিঁড়ি এখানেই
ঘুরে ঘুরে ওঠা যায়
অথবা ঘুরে ঘুরে নেমে আসা যায়
ফুলে ফসলে ভরা হাসি কান্নার ফুল
শূন্যের ভেতর ফুটে ওঠে ঝরে যায়
আলো আঁধারে হিজিবিজি
চেতনার মাঠে প্রেমের দেবতা নেমে আসে
বিষাদের মালা পরে আসি তার কাছে
শব্দ জানে, শব্দই জানে
কত অভিমান
যা কখনও লেখা হয় না, ছোঁয়া হয় না সমস্ত জীবনে
সর্প সমাচার
ফণা দুলছে, ফণা দুলছে
আমরা শুধু ডুগডুগি বাজানো দেখছি
কালো নীলচে বাদামি গলায় চন্দ্রহার
কী সুন্দর কী সুন্দর সর্প সমাচার
সকালের রোদে আমাদের ছায়া পড়ছে
দীর্ঘ ছায়াগুলি নড়ছে চড়ছে
আমরা পার করছি শীতকাল
যদিও কেউ কেউ কুয়াশা কাতর
সাপুড়ে সব বলে দিচ্ছে কার কেমন জ্বর
কার কেমন ওষুধ দিলে ছোবল দেবে না সাপিনিও
ভালবাসবে সেরকম ভালবাসা পেলে
যদিও জলে ও ডাঙায় আমাদের জীবন
বিচ্ছেদ লিখে যায়
আবার হিস্ হিস্ শুনি, থলিতে জমা হচ্ছে বিষ
আমাদের আকাঙ্ক্ষারা প্রতিবেশীদের ঘরে যায়
স্বপ্নের ভেতর গর্ত খোঁজে তারপর সেখানে আশ্রয়
আমরাও লাল নীল সাদা বিসর্পি
ডুগডুগি বাজলে দোল খায়
কালের ঘরণী
হাঁড়ি বাসন মেজে নিচ্ছি
বিবেক মেজে নিচ্ছি
রান্নাবান্না হবে
তারপর চেতনা বসবে এসে
আমার উনুনে কারা যে আগুন দিয়ে গেল
চাল ডাল নাকছাবি সব
দলাদলি ডলাডলি
মৎস্য কচু লাউ
আর জ্ঞানগর্ভ বাক্যসম্ভার
অনেক বেলা হয়ে গেছে
ছায়াটি বসে আছে দোরের কাছে
ভাগ্যবিড়ম্বিত নপুংসক
বাঁচতে চাইল
তার বাঁচার দীর্ঘশ্বাস শুনল বাতাস
মাচার উপর বসে পা দোলাচ্ছে কাল
কালের ঘরণী হতে চাইছে স্বপ্ন তার
খাওয়া-পরা আর অস্ফুট ইচ্ছাগুলির
সে-ই নেবে সমস্ত ভার
আমি হাসতে পারলাম না
ছায়াটি আমারই নীরব স্বীকার
জরুরি ব্রিজ
একটা ব্রিজ তৈরি করছি
ইঁটের বদলে শব্দ, শব্দে শব্দে বাক্যের দেয়াল
বিশেষণ ক্রিয়াপদ সিমেন্ট ও বালি
জরুরি ব্রিজ তাই আমিও ভীষণ পরিশ্রমী
নবজন্ম, পুরোনো জন্ম সবাই পার হবে
এপারে ওপারে কত নিষিদ্ধ আনাগোনা
অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে বলে
সকলেরই তাড়া জেগে ওঠে
মাঝখানে কালপ্রবাহের স্রোত
ভাসিয়ে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে যুগ
কত কত পাতক-পাতকীর হৃদয় –
সবই তো হৃদয় তবু!
আহা! উষ্ণ নরম প্রগলভ শীতল…
কামোদ্রেক ফুলের গন্ধে তাদেরও শোভিত পুলক জেগে ওঠে
অথবা বিনিদ্র কষ্টের রাত
জরুরি ব্রিজ তাই আলো-আঁধারের জমাট অনুভূতি
সংকেতে সততায় ঘেরা তার বোধের দেয়াল
দীর্ঘশ্বাস পার হবে, হাসিখুশি অথবা সাহসী
নীলিমার ঘোরে কেউ নীরব বনশ্রী
কেউ ভোর প্রীতির সাম্রাজ্ঞী
কেউ বিনম্র মায়াময়ী
এপার ওপার যদি একাকার হয়
ঈশ্বর ও নিরীশ্বর এসে হাত ধরে
বলো তবে কী চায় আর এই পৃথিবীতে!
অন্তরীক্ষ
অপার্থিব মাকড়সাড়া নেমে আসে
চেতনা এখন মৃদু ঘুমে
দুঃস্বপ্নের বারান্দায় মেঘলা জড়তা
প্রাচীন সভ্যতার মতো সময় এখন
নিবিড় জঙ্গমে ভাঙছে নদী
আমাদের অন্তর্বর্তী নিঃসীম অবধি
সমস্ত শোষিত আত্মা থেকে
জন্ম নিচ্ছে ধ্বনি
অদ্ভুত তরঙ্গ স্তরে রচিত সে কাহিনি
কেহই জানে না
শুধু চরাচরে আমাদের জাগরণ ক্রিয়া
তা দিয়ে সাজানো হয় সংসার
ভেতরে ভেতরে ক্ষয় মৃত্যুর পরকীয়া
রুমাল
একটি রুমাল পাখি হয়ে উড়ে গেলে
রুমালে আঁকা গোলাপটিও চলে যায়
আমি ব্যথাতুর হৃদয়ে তার ছবি আঁকি
বহুদিন পর এ শহরে নেমেছে জাদুকর
শুকনো নদীখাতে এবার বইবে জোয়ার
সব কষ্ট ভেসে গেলে বাগানের শুকনো গাছে
ফুল হাসবে—
জাদুর পাখিরা এসে বসবে ডালে ডালে
আমার আকাশে এক খণ্ড মেঘ ভেসে এলে
আমিও খুঁজে পাবো হারানো রুমাল…
আদিম কবিতারা
রাত্রি নেমে আসছে আর আমাদের সব কথা ফুরিয়ে যাচ্ছে
শ্বাসবায়ুর চলাচলে তোমার নোলক দুলছে
তোমার চুলে সূর্যাস্তের রং ছড়িয়ে পড়ছে
তোমার আর আমার দূরত্ব ক্রমশ ধূসর হয়ে যাচ্ছে
রূপকথার কোনো পাতালপুরীতে আমরা ঢুকে যাচ্ছি
আমাদের হৃৎপিণ্ড মরচে ধরা পাথর
আমাদের না-বলা কথাগুলি রাত্রির দিশেহারা পাখি
কোথাও বাসা নেই তাদের শুধু বাসাবদল আছে
পৃথিবীর সমস্ত কবিরা নিজেদের আবিষ্কার করছে
আর তাদের প্রেমিকার চুলে সূর্যাস্তের রং মুছে দিচ্ছে
বাতাসে ভেসে আসা খণ্ড খণ্ড চুমুগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে
শব্দে শব্দে সাজিয়ে দিচ্ছে নতুন অর্থভাণ্ডার
আমরা হারিয়ে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ পরস্পর শূন্য ছুঁড়ে দিচ্ছি
আর শূন্যের ভেতর শূন্য হয়ে পাক যাচ্ছি এক একটি পৃথিবীর মতো
আদিম কবিতারা নেমে আসছে অদ্ভুত এক অন্ধকার
ভিখির
ভালোবাসা বাড়তে বাড়তে কোথায় যাবে?
জ্ঞান বাড়তে বাড়তে কোথায় যাবে?
রোজ শুধু সাঁতার দিচ্ছি এপার থেকে ওপারে
আর স্নান করছি আমাদের ঈশ্বরের দিঘিতে
তারপর দুপুর গড়ে যাচ্ছে
বিকেলের নির্জনে আমি ও আমার ছায়া
হাঁটু গেড়ে বসছি পাশাপাশি
একটা ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে জীবন
আর সেখানেই লিখে রাখছি সব প্রশ্নগুলি
আমাদের প্রত্যেকেরই এক একটা রাত্রি আছে
রাত্রির অন্ধকার আছে
আমাদের প্রত্যেকেরই ডুবে যাওয়া চাঁদের
স্মৃতি জেগে থাকে
আমরা কার কাছে তবে রোজ ভিক্ষে চাই
শূন্য দুই হাত মেলে বসে থাকি শুধু?
ভালোবাসা কখনো ক্ষুধা মেটায় না আমাদের
জ্ঞান কখনো তৃষ্ণা মেটায় না আমাদের
শুধু ঈশ্বরের দিঘি এপার ওপার করে
আমাদেরই এক তীব্র নির্বোধ!
মহিমাময়
মহিমাময়, সবই মহিমাময়
আলোর পানে চেয়ে চেয়ে
সবাই দেখি আলোর জন্ম দেয়
কার বাঁশিতে কখন সুর ওঠে
কেউ বুঝি না—
পয়ার ভেঙে অনেক পয়ার হয়
ঝরনা ভেঙে অনেক ঝরনার মেয়ে
আমরা শুধু পাঠশালাতে কলরব পাই
চলো উদাসীন, নতুন দিন দেখে আসি
কেমন বিপ্লব এসেছে, কেমন বিপ্লবী
আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ…
আর তার কুলকামিনী…
সাবধানে পা ফেলো, জলাশয়ে কুমির আছে
ঝরনাদের নতুন পোষা কুমির!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks