কবিতাগুচ্ছ
যাহিদ সুবহান
হাঁদারামের দিনাতিপাত
নিশ্চিত হার জেনেও-খরগোশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে
কচ্ছপের পক্ষ নেয়া- আমি এক বোকা দৌঁড়বিদ
গলাটা নিচু করে, নিজপায়ে হেঁটে হেঁটে
হাসিমুখে পরে নেই পরাজয়ের গোল্ডমেডেল
বুদ্ধিমানদের পাড়ায় দীর্ঘবাসের পরও
হয়ে আছি হদ্দ বোকা-হাদারাম
জেনে বুঝেই করে যাই বোকামীর চাষাবাদ
জেনেছি সব খেলা শেষ হলে পরে
বোকাদেরই হয় শেষ জয়
পৃথিবীর সব অতিচালাকের ভীড়ে তাই
দেখে যাই হেরে যাওয়াদের বুদ্ধি বুদ্ধি খেলা ...
দরজাগুলো এঁটে যাচ্ছে
অবিরত দরজাগুলো এঁটে যাচ্ছে
হাত দিতেই দূরে চলে যাচ্ছে দরজা সমেত ঘর
দেয়ালে সেঁটে যাচ্ছে হাজারো মুখচ্ছবি
আর ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে জীবনের নিয়তি।
এভাবে দরজাগুলো এঁটে যেতে যেতে
পৃথিবীতে যেদিন আর কোনো খোলা দরজা থাকবে না
আমরা যেদিন বুঝে যাবো
মূলত দরজা ঘর কিংবা পৃথিবীর অপ্রয়োজনীয় বস্তু
এবং আকাশ ছাড়া আমাদের কোনো দরজা দরকার নেই
সেদিন এঁটে যাওয়া পৃথিবীর সব দরজা ভেঙে আমরা
ঘরগুলোকে শরতের আকাশ করে দেব...
চলনবিলের জল এবং জ্যোৎস্না
কোন সে প্রেমিক হয়েছে মাতাল
ভরা ভাদ্রের এই জ্যোৎস্নার প্রেমে
কেই বা দিল এমন হিম পরশ
আজ অবেলার সন্ধ্যায়
বিভোর হয়ে কে শুনছে ডাহুক পাখির গান
পেঁচাতো ঘুমিয়েছে এই নিশুতি সময়ে
সব ঝঞ্ঝাট দূরে ঠেলে
শামুক-পাখি-গাছ আর পদ্মরা সব
করছে পূজো চলনবিলের জলজ্যোৎস্নার
আহা ভরা ভাদ্রের চাঁদ
আহা এই রুপালি জ্যোৎস্না
আহা চলনবিলের জল
এই চাঁদ কিশোরবেলার প্রেমিকা...
বিনয় মজুদারকে উৎসর্গিত পিয়াস মজিদের কবিতা পড়ুন এখানে
ফেয়ার এন্ড লাভলী এবং বর্ণবাদের পৃথিবী
কে দেখেছে কোনদিন মর্তে নেমেছে অপ্সরা
কে জেনেছে ওথেলোর রূপের রহস্য
চোখ থাকলে পৃথিবীর সবই সুন্দর
তফাৎ যা শুধু তা দেখার মাঝে
ভেবে দেখো সবই দৃষ্টিভ্রম এবং প্রতারণা
গাছ আর পাখিদের কোন প্রসাধনী নেই
নেই পাহাড়ের ঠোঁটে কোন লিপস্টিক
জ্যোৎস্নারা সয়ম্ভূ সুন্দর
শুধু মানুষ সযত্নে ছুটছে মরিচিকার পিছে
দিন দিন বাড়ছে দুরত্ব মানুষে মানুষে
নিউয়র্কের রাস্তায় মরে পড়ে থাকে কালো মানুষ
ম্যান্ডেলাও তো কালো মানুষ ছিলেন
বর্ণবাদের আরেক নাম ফেয়ার এন্ড লাভলী
তোমাদের চটকদার বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড নামাও ...
অপেক্ষায় থাকো
আর তো মাত্র ক’টা দিন-একটু থাকো অপেক্ষায়
তোমাদের মাঝে নিয়মিত হয়ে যাবো আবার
ও সবুজ পৃথিবী, ও নীল আকাশ-- একটু সময় দাও
ও দূর্বা--আমিও আছি অপেক্ষায়
তোমার সাথে ল্যাপ্টে থাকব বলে
একদিন আমারও হবে সময়, তোমাদের মতো
দেখো তোমাদের মতোই হবো বিষ্ময়
থাকো অপেক্ষায় আকাশের বুকে
হবে আমাদের যৌথজীবন
যৌবনবতী কোনো এক জ্যোৎসার রাতে...
জলপাই রঙের জীবন
মাথার উপর জোৎস্নাময় আকাশ
আকাশের নিচে যৌবনবতী নদী
আর নদীর বুকে বুকফোলা জলের ঢেউ
কাশবনে ঘর বাধা পাখির মতো
আমাদেরও ছিলো একটা রঙিন জীবন
আহা জীবন--জলপাই রঙের জীবন!
আহা জীবন-- সবুজ জীবন
কুমড়ো ডগার মতো কোমল হাতজোড়া
ছুয়েছিল এই সাধারণ জীবন
সেই স্মৃতি ভাবতে ভাবতে, ভাবতে ভাবতে
জুঁই, তোমাকেই ভুলে যাই মাঝপথে ...
চড়কে ঝুলে আছে মানুষ
গতবার বৈশাখে দেখেছিলাম চড়কমেলা
অনার্য সন্তানেরা যাকে পূজো মনে করে
কী ভয়ানক এই চড়ক পূজো!
কী ভয়ানক এই চড়ক মেলা!
স্বেচ্ছায় পিঠে লোহার বিরাট বড়শি গেঁথে
চড়কে ঝুলে ঘুরতে থাকে একজন মানুষ
ঘোরে আর ঘোরে ঠিক পৃথিবীর মতো
কোন ব্যথা নেই; কোন অভিযোগ নেই যেন
পিঠের ব্যথাগুলো দেবতার খুশি
পিঠের ব্যথাগুলো মানুষের খুশি
পৃথিবীর মানুষ দেখে দেখে মনে হয়
বিরাট বড়শি পিঠে গেঁথে সব মানুষেরা
ব্যথা ভুলে ঝুলে আছে ঘুর্ণায়মান এক বিশাল চড়কে ...
ভেজা দোয়েল কিংবা চলনবিলের বৃষ্টি
শ্রাবণের এই মাতাল বৃষ্টিতে-তুমি ভিজে যাও
তুমি ভিজে যাও ও দোয়েল-এই ভেজা বরষায়
ঝড়ো বৃষ্টিতে মুছে যাক, ভেসে যাক
আমাদের আছে যত বদনাম
চলনবিলের প্রেম বৃষ্টিতে-তুমি ভিজে যাও
তুমি ভিজে যাও ও দোয়েল-এই ভেজা দুপুরে
কলাপাতা রঙ ফিরে পাক পথ, মাঠ-ঘাট
আর ঘুঁচে যাক, মুছে যাক যত অপবাদ
শ্রাবণের এই বৃষ্টির জল ছুয়ে যাক
তোমার ঠোঁট-পালক আর কুমারী শরীর
তুমি ভিজে যাও আর সুরেলা গলায় গেয়ে যাও
হাজার বছর ধরে গাওয়া আমাদের যৌথ বৃষ্টি সংগীত ...
দরজাগুলো এঁটে যাচ্ছে
অবিরত দরজাগুলো এঁটে যাচ্ছে
হাত দিতেই দূরে চলে যাচ্ছে দরজা সমেত ঘর
দেয়ালে সেঁটে যাচ্ছে হাজারো মুখচ্ছবি
আর ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে জীবনের নিয়তি।
এভাবে দরজাগুলো এঁটে যেতে যেতে
পৃথিবীতে যেদিন আর কোনো খোলা দরজা থাকবে না
আমরা যেদিন বুঝে যাবো
মূলত দরজা ঘর কিংবা পৃথিবীর অপ্রয়োজনীয় বস্তু
এবং আকাশ ছাড়া আমাদের কোনো দরজা দরকার নেই
সেদিন এঁটে যাওয়া পৃথিবীর সব দরজা ভেঙে আমরা
ঘরগুলোকে শরতের আকাশ করে দেব...
প্রতিক্ষার বৃষ্টি কিংবা দোয়েলের ঠোঁট
সময় পড়ে গেলে- পড়ে থাকে স্মৃতি
স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে না কেউ
কেউ থাকলেই কী- কে রাখে খোঁজ!
সময় চলে যায় সময়ের মতো
বানে ভাসা জলের মতো বাধাহীন
পূরোনো খেরোখাতা ছুড়ে ফেলো
ইরেজারে মুছে দাও পৃথিবীর সব লেনদেন
চলো ভুলে যাই জীবনের সিলেবাস
বরং প্রতিক্ষার বৃষ্টির শীতল জল হয়ে
দোয়েলের ঠোঁট ছুয়ে গেলে ক্ষতি কী...
ইরেজারে মুছে দাও সব জন্মের দাগ
পাহাড়ের ভরা জঙ্গলে ফুটে থাকা কলাবতী ফুল
কারও চোখ জুড়ালেই কী, না জুড়ালেই কী?
কে রাখে খোঁজ- কেই বা লিখে রাখে ইতিহাস
প্রকৃতি সয়ম্ভু সুন্দর- বিলায় সুন্দর নিজের খেয়ালে
ফুলের পিছু লেগে লাভ কী?
বড়জোর ঝিনুকের ক্ষতি করতে পারো
লুটে নিতে পারো তার মুক্তো
ছিড়ে খেতে পারো তার মাংসের স্বাদ
যদি চাও, ছুড়ে ফেলো আর্কিমিডিসের কম্পাস
কী দরকার বৃত্ত- জ্যা- পরিধি মাপার
কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দাও জ্যামিতির হিসেব-নিকেষ
ইরেজারে মুছে দাও সব জন্মের দাগ...
বিবর্ণ দিবসের গান
শেয়ালের ডাক বেশি বেশি শোনা গেলে
বুঝে নিও, ওরা সব দল বেঁধেছে ঝোঁপে
কোকিলের গান থেমে গেলে পরে
বুঝে নিও, বসন্ত এসে ফিরে গেছে
সিদূরে মেঘ দেখলে ভয় পেও না
বুঝে নিও, বৃষ্টি আসবে খুব অল্প সময়ে
চৈত্রের খরতাপে পাতা ঝরে গেলে
বুঝে নিও, কুড়িসমেত সবুজ পাতা আছে প্রতিক্ষায়
নষ্ট সময়ের আস্ফালন যদি দেখো
বুঝে নিও, এ ক্ষণিকের বিবর্ণ দিবসের গান...
দিও না চিঠির জবাব
হঠাৎ ভেঙে যাওয়া শেষ রাতের ঘুম
মনে করায় যদি গত বিকেলের স্মৃতি
জানালায় চোখ রাখো, দেখে নাও ভোরের আকাশ
শুনে নাও দোয়েল আর ভোর পাখিদের গান
গোধূলির স্মৃতি মনে পড়ে গেলে
শাদা বকেরা যদি স্মৃতিতে আসে
ভেলা ভাসিয়ে যেও শালুক বিলে
সেখানে শামুক আর বিলপদ্মদের দেখা পাবে
বিষণ্নতা তবু যদি না ফুরায়
নিও পূরোনা সে সুগন্ধি চিঠির খোঁজ
মনে চাইলে দিও- না চাইলে দিও না
ফেলে রাখা সে চিঠির জবাব...
যৌথ সময়ের পিছুটান
সমরে ঘূর্ণিপাকে দেখা হবে হয়তো আমাদের
দেখা যাবে, তুমি আগের মতো নেই-
তোমার দু’হাতে থাকবে না জানি লালচুড়ি
আর লাল ঠোঁটে পূরোনো সে মুচকি হাসি
সিঁথির উড়ন্ত কেশগুলো অবিরত
মেঘাচ্ছন্ন সূর্যালোকের মতো দেখাবে
চোখগুলো হয়ে উঠবে যুদ্ধ ফেরত
কোনো এক ক্লান্ত সেনার মতো
ঢেউ ভাঙা নদীর মতো-
হয়তো আমিও পড়বো ভেঙে
থাকবে না আর অচেনা গাঙচিল জীবন
থাকবে না ফুল-পাখি-আর গাছেদের অপেক্ষা
হয়তো থাকবে যৌথ সময়ের পিছুটান
চাতক পাখি হয়ে যাব একদিন
আগের মতো দেখবে না পৃথিবী আর
কোনো এক কিশোরীর দূরন্ত প্রেমিকের হাঁটাচলা...
ফাঁকা কলস কিংবা শব্দের হুংকার
ফাঁকা কলস বাজিয়ে দেখা হয়নি কখনো
তবে শুনেছি রাজিব পাগলার কলস গান
ধাতব কয়েন আর কলসের কী সুন্দর মিউজিক
কী মধুর ছন্দ, কী ঝংকার সে কলস গানে
ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার দৃশ্য মজার
ফাঁকা আওয়াজ সময়কে করে অস্থির
শরতের ফাঁকা আকাশ আরও সুন্দর
ফাঁকা চর, ফাঁকা মরুভূমি ভয়ানক
ফাঁকা বাশি দেখি বাজে ভালো
ফাঁকা বুলির দৌড় বড়জোর অনতিদূর
মানুষও কী বাজে, ফাঁকা কলসের মতো?
মানুষেরও হয় কি আওয়াজ?
-----------------------
যাহিদ সুবহান
সম্পাদক-সপ্তর্ষি,
মোবাইল: ০১৭২৩৯৯৯১৪৭
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks