গুচ্ছকবিতা
তমিজ উদ্দীন লোদী
তমিজ উদ্দীন লোদী
অচেনার জলে ডুবে হিপনোটিজম
একটি সুতো, অদৃশ্য, বাঁধে চোখের তারাকে জমিনের পাঁজরে। ঘুমন্ত পাখিরা বলে যায় সময়ের গান, শুনি শুধু তবুও নিঃশব্দের সুর।
মন, একখণ্ড কাঁচ, তার ভিতরে দুলছে অচেনা মুখ, ঝরে পড়ে পরিচয়, মিশে যায় আয়নায়।
কার স্পর্শে কাঁপে বাতাস? কে নাম লেখে জলের উপরে? যে তরঙ্গে ভেসে যায় ইচ্ছার নৌকা, তার তীরে দাঁড়াই আমি, একা, আর এক আমি।
একটি প্রশ্ন জাগে নীলে রঙের ভোরে: স্বপ্ন দেখে কে, আর কে জাগে?
স্বপ্নের ছাঁচে গড়া শহর ইউটোপিয়া
সোনালি রোদে গলিত এক নদী যার জলে ভাসে সময়হীন ফসল , পাথরের বুকে আঁকা পথগুলো চলে যায় আলোর ভাঁজে
প্রতিটি জানালা খোলে একটি করে বাগানের দিকে যেখানে ফল পাকে রংধনুর স্পর্শে
মানুষের মুখে লেগে থাকে অনাবিষ্কৃত হাসির রেশ , কোনো প্রশ্ন নেই শুধু উত্তর দোল খায় বাতাসের দোলনায়
ঘড়ির কাঁটা হিমায়িত একটি নীলমণি চুপিসারে স্বপ্ন আর জাগরণের সীমানায় জমাট বাঁধে সোনালি মধু
কিন্তু দিগন্তে জ্বলে একটি তারা—অসীম একাকী কারণ সে জানে নির্ভুল সুরের মাঝে লুকিয়ে আছে সবচেয়ে বড় ফাটল।
অচেতনের নদীপথ ফ্রয়েডের স্বপ্ন
একটি সিঁড়ি, নামে অন্তহীনে, যেখানে মুখোশ পড়ে থাকে আলোর খাঁজে। প্রতিটি ধাপে লুকায়িত শিশুরা খেলছে মাটির মূর্তি দিয়ে— ভাঙা, গড়া, চিরায়ত।
কাকতাড়ুয়ার নাচ জলের নিচের বাগানে, সেখানে ফুটেছে রক্তজবা অবদমিত বসন্তের।
কখনো ছুরির কিনারে হাঁটে এক পালকহীন পাখি, তার চোখে পুরনো সব চিঠি, অক্ষরগুলো রক্তমাখা।
সময়ের আয়নায় ভেসে ওঠে অস্বীকৃত মুখ, যাকে চিনি, তবু চেনা হয় না, যে কথা বলতে চায়, কণ্ঠ বন্ধ।
স্বপ্ন সেই সুড়ঙ্গ , যেখানে আলো-আঁধারের সীমানা মুছে যায়, আর আমি—একজন পথহারানো অন্বেষক খুঁজে ফিরি হারানো চাবি অনন্ত ল্যাবিরিন্থের দরজার জন্য।
নায়েগ্রা
শব্দ সেখানে নীল নয়, সবুজ নয়, শুধু এক অবিরাম পতনের ধ্বনি, পাথরের বুকে কাঁপে অনন্তের ভ্রুক্ষেপহীন রাগ।
জলের ভাষা বুঝি না, তবু শুনি অনাদি এক গান, যে গানে লিপি নেই, শুধু শূন্যে লিখে যায় শুভ্র ফেনিল রেখা।
কখনো বা মনে হয়, এ কোন্ সময়হীন প্রাণীর অবিরাম ক্রন্দন, কিংবা পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসা এক নিশ্বাস।
আমি দাঁড়াই দূরত্বে, শুনি আমার নিজের মৌনতা ঝরে পড়ে জলরাশির মতন, কোনো উত্তর নেই, শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভেঙে পড়ে সে অন্তহীন গর্জনে।
অদৃশ্য স্পর্শ প্লেটোনিক
ভালোবাসি, তবু ছুঁই না; যেন দুটি তারা আলোকমুখী, মধ্যে অনন্ত রাত্রির ব্যবধান।
তোমার হাসি সুর হয়ে বাজে আমার নিঃশব্দ পিয়ানোর তারে, স্পর্শহীন স্পন্দনে কাঁপে বাতাস।
প্রত্যক্ষের চেয়ে সত্য এই দূরত্ব, যেখানে রূপ হারায়, রঙ হয় বর্ণহীন, শুধু থাকে শুদ্ধ আলোর কম্পন।
কখনো ভাবি, যদি স্পর্শ পেতাম তবে ভাঙে কি সে অদৃশ্য সেতু যে সেতু বয়ে আনে চাঁদের রৌপ্যকণা?
তবু থাকি দূরে, নিকটে, এক অলীক বৃত্তের পরিধিতে ঘুরি, যেখানে প্রেম শুধুই এক অনাহূত সঙ্গীত , বাজে শূন্যতায়, শুনি আমি একা।
শিয়ালের ছায়ায় ম্যাকিয়াভেলি
ক্ষমতার রং নীল নয়, লাল নয়, এক ধূসর বাষ্পের খেলা যেখানে নৈতিকতা ঝরে পড়ে পাথরের ফাটল থেকে অনাবশ্যক শিশিরের মতো।
প্রতিটি মুকুটই আগুনের বলয়, যার তাপমাত্রা মাপা হয় রক্তের স্ফুটনাঙ্কে, আর হৃদয় শুধুই একটি গণনাকারী যন্ত্র ভারী দরজার আড়ালে লুকানো।
সিংহের চামড়ায় মোড়া এক জ্যামিতিক সত্য । ভালোবাসা নয়, ভয় হচ্ছে সেই কাঁচ যার মাধ্যমে দেখা যায় অস্থির সিংহাসনের প্রতিচ্ছবি।
আমি পড়ি না কোনো গ্রন্থ, কেবল দেখি দর্পণে অস্পষ্ট মুখ, যেখানে নীতির বাণী জমাট বাঁধে বরফ হয়ে, আর প্রয়োজন গলিয়ে দেয় সবকিছুই একটি তরল সিদ্ধান্তে।
কূটবুদ্ধির অঙ্ক চাণক্যের ঘেরাটোপে
রাজ্যের রেখা আঁকা হয় না রক্তে, আঁকা হয় চোখের কোণে লুকনো তীক্ষ্ণতায় ।প্রতিটি মন্ত্র শব্দ নয়, একটি তীর যা লক্ষ্য খোঁজে নিজেই।
ক্ষমতা কোনো সিংহাসন নয়, একটি সর্পিল সিঁড়ি যার প্রতিটি ধাপই গণনার ফল; ভালোবাসা নয়, আনুগত্যই সেই মূলমন্ত্র যা বেঁধে রাখে মাটি আর মানবকে।
আমি দেখি না মুখ, দেখি প্রবণতা; শুনি না বাণী, শুনি স্বার্থের অনুরণন। নীতিশাস্ত্র নয়, প্রয়োজনই সেই কাঁচা সোনা যার চেয়ে দামি শুধু সময়ের ছাঁচ।
পাথরকে পাথর দিয়ে কাটা একটি শিল্প, যখন বাতাস গুনে যায় প্রতিটি পালকের ওজন; আর সত্য সবসময়ই থাকে কৌশলী মৌনতার আড়ালে, যেমন অন্ধকারে জলে কুমিরের চোখ জ্বলে শুধু একটি মুহূর্তের জন্য।
মুসোলিনী লোহার মুখোশে
ভাঙা মার্বেলের বুকে একটি নাম শুধু কাঠগড়ায় দাঁড়ায়; যে সূর্য নিজেই নিভে গেল অস্তাচলের আগুনে।
ক্ষমতা ছিল এক উল্টো পিরামিড, মাথায় দাঁড় করানো , ঝড় এলে প্রথমেই ভেঙে পড়ে যে বাড়ি মাটিকে চিনতে ভুলে যায়।
লোহার লাঠি দিয়ে বানানো হয়েছিল বুলেট, কিন্তু কণ্ঠস্বর গড়া হয়নি । শুধু প্রতিধ্বনি ফিরে আসে শূন্য প্রাসাদের দেয়ালে।
ইতিহাস এক করুণ আলোকচিত্রকর যে ধরে রেখেছে সেই মুহূর্ত যখন ছায়া মানুষটিকে গ্রাস করে নিজেরই দর্পণের আয়নায়।
আজ শুধু পড়ে থাকে ধুলোয় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ভাস্কর্য, আর সময়ের অমোঘ বিচার যা লিখে দেয় চূড়ান্ত পঙক্তি সব ঔদ্ধত্যের ইতিকথায়।
ধূসর ঘোড়ার যাত্রা হালাকু
সেই যে এলো ধূসর ঘোড়ায় চড়ে, পিছনে রেখে আগুনের নদী , যে নদীতে ভাসে গ্রন্থাগারের পৃষ্ঠা আর তারার গণনার পুঞ্জীভূত রাত্রি।
তার চোখে কোনো রাগ নেই, শীতল বরফ । ক্ষমতা কোনো উৎসব নয়, একটি যন্ত্রণাহীন অঙ্ক যেখানে নগরগুলো শূন্যে মিলিয়ে যায় রক্তস্রোতের হিসাবের মতো।
ইটের গায়ে যখন লেগে থাকে সভ্যতার শেষ শ্বাস, তখন সময় হয়ে ওঠে এক শিশুহারা মা যার কোল খালি , মা শুধু ধুলোর স্মৃতি।
সে চলে গেছে অনেক আগে, তবু এখনো জেগে ওঠে কোনো ভাঙা প্রাসাদের ছায়ায় ক্ষমতার সেই নিষ্পেষণ, যেখানে মানচিত্র পুড়ে যায় আর ইতিহাস জন্ম নেয় একটি অশ্রুবিহীন কাহিনীর গর্ভ থেকে।
nobel prizev:2025 on litterature here
ইসলাম তৌহীদের কবিতা পড়ুন এখানে
মহসিন খোন্দকারের কবিতা পড়ুন এখানে
গল্প বরফের ছুরি পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,উত্তরাধুনিক কাব্যধারার যাত্রাঃ মতিন বৈরাগী-এখানে
প্রবন্ধঃ রাজনীতি ও সাহিত্য পারস্পরিক সম্পর্ক পড়ুন এখানে
কবি মজিদ মাহমুদের গুচ্ছকবিতা পড়ুন এখানে
প্রবন্ধ,নজরুলের রহস্য,পড়ুন এখানে
সে নিজেই হয়ে ওঠে একমাত্র প্রহরী, যার ছায়া সূর্যকে গ্রাস করে, আর সমস্ত কণ্ঠস্বর জমাট বাঁধে একটি মাত্র মূর্তির পাদদেশে।
তার ভাষায় প্রেম মানে আনুগত্য, স্বপ্ন মানে নির্দেশিত পথ, ইতিহাস এক নরম মাটি যাকে সে বানায় নিজের ছাঁচে।
প্রতিটি দরজায় বসে ভয়, প্রতিটি আয়নায় তারই মুখ; সময় হয়ে ওঠে একটি স্তব্ধ নদী যে নদী শুধু পিছনেই বয়।
তবুও রাতের গভীরে জেগে ওঠে অসংখ্য চোখ, আর ধীরে ধীরে ম্লান হয় সেই একক সূর্যের আখ্যান; কারণ পৃথিবী ঘোরে স্বৈরতার কবরের ওপর দিয়ে একটি নতুন প্রভাতের দিকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks