অনলাইন সাহিত্যচর্চা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
ড. আলী রেজা
বর্তমান যুগকে অনলাইন সাহিত্যের যুগ বলা যায়। সাহিত্যের যুগবিভাজনে বিভিন্ন যুগের সাহিত্যচর্চার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। বৈদিক যুগের সাহিত্য ছিল অনেকটা দেবলোকের সাহিত্য। দেবদেবীদের কর্মকান্ড ও তাদের চরিত্রবৈশিষ্ট। বর্ণনা করাই ছিল সে যুগের সাহিত্যের প্রধান বিষয়। পৌরাণিক যুগের সাহিত্যও একই প্রবণতা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন সাহিত্যের এই দেবদেবী বন্দনা, ঈশ্বর বন্দনা ও রাজবন্দনার স্তর অতিক্রম করে সাহিত্য ক্রমশ মানবকেন্দ্রিক হয়েছে। বর্তমান সাহিত্য প্রধানত মানবকেন্দ্রিক। এই মানকেন্দ্রিকতার যুগে পৌঁছার জন্য সাহিত্যকে অনেক পথ পারি দিতে হয়েছে। সাহিত্যের অতিমানবীয় বা অতীন্দ্রিয় উপাদানগুলোর অসারতা প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞান এগিয়ে এসেছে। বিজ্ঞানের প্রভাবে সাহিত্য হয়ে উঠেছে বাস্তব ও ইহজাগতিক । আধুনিক যুগে আমরা সাহিত্যে বাস্তবতার চিত্রই দেখি । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে সাহিত্যের বিষয়গত পরিবর্তন যেমন হয়েছে তেমনি সাহিত্যের নির্মাণশৈলী ও উপস্থাপন প্রক্রিয়ায় এসেছে লক্ষণীয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ সংযোজন হলো অনলাইন সাহিত্য।
অনলাইন সাহিত্য নিয়ে সাহিত্যাঙ্গনের প্রায় সবাই কথা বলেন। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। যারা পক্ষাবলম্বন করেন তাদেরও যুক্তি আছে। যারা বিপক্ষে বলতে চান তাদেরও যুক্তি আছে। পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আমি কিছুই বলবো না। এ লেখার বিষয়ও সেটা নয়। আমি যেদিকে পাঠকের দৃষ্টি ফেরাতে বলি তা হলো মানের বিষয়।
বর্তমান সময়ে যারা নিয়মিত অনলাইনে সাহিত্যচর্চা করছেন তারা সবাই যে মানহীন সে কথা বলা সঙ্গত নয়। তবে ভার্চুয়াল সাহিত্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানহীনতার অভিযোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, মূলধারার লেখকগণ এখনো অনলাইন সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত হননি। অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাহিত্যচর্চায় খুব সহজেই প্রচার পাওয়া যায়। কিন্তু সাহিত্যের এ্যারিস্টক্রেসি রক্ষা হয় না। ভার্চুয়াল সাহিত্যের যারা পাঠক তাদের একটা বড়ো অংশই সাহিত্য বোঝে না। তাদের লাইক-কমেন্ট যথার্থ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অভিনিবেশ সহকারে না পড়েই লাইক-কমেন্ট করে। এতে কবি-লেখকগণ যথার্থ মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হন। ভার্চুয়াল সাহিত্য মূল্যায়নের মূল মানদ- হলো লাইক-কমেন্ট। লাইক যত বেশি লেখা তত জনপ্রিয়; পজেটিভ কমেন্ট যত বেশি লেখা তত মূল্যবান। মূল্যায়নের এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড়ো ফাঁক হলো, লাইক-কমেন্ট করার জন্য লেখাটা না পড়লেও চলে। পরিচিতজনের লেখায় লেখককে ভালোবেসেই লাইক-কমেন্ট দিয়ে দেন অনেক পাঠক। লেখা মূল্যায়নের প্রয়োজনবোধ করেন না। লেখক মূল্যবান হয়ে ওঠেন লাইক-কমেন্টের জোরে।
মান যাচাই সংক্রান্ত এ ধরনের অসঙ্গতি অনলাইন সাহিত্যকে সস্তা করে তুলেছে। ফলে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে প্রকাশিত সাহিত্যকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না। এতো গেল মানের বিষয়। অনলাইন সাহিত্যের পরিমাণ নিয়েও আছে নানা প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে চলছে চরম নৈরাজ্য। এতো কবি, এতো কবিতা সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ মানহীন কবিতা পরিমাণে বাড়লে তা সাহিত্যের আভিজাত্য ক্ষুণ্ন করে। দেশে এখন সৃজনশীল সাহিত্যের যত গ্রন্থ প্রকাশ হয় তার মধ্যে কবিতার সংখ্যাই বেশি। একজন কবি যদি পরিচিতি বা প্রচার পাওয়ার উদ্দেশ্য না লিখে কবিতার শিল্পমান রক্ষা করে লিখেন তবে তাঁর লেখার পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ার সুযোগ কম। আজকাল অনেক কবি-লেখক শত শত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কিন্তু পাঠক তাঁকে চিনেন না। আবার অল্প লিখে সাহিত্যাঙ্গনে সমাদৃত হয়েছেন এমন লেখকও আছেন। কাজেই লেখার পরিমাণ বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে লেখক বের হয়ে আসলেই তা সাহিত্যের জন্য মঙ্গল। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যার নিরিখে লেখককে মূল্যায়ন করা উচিৎ নয়। প্রকৃত পাঠক সেটা করেনও না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতায় বলেছেন, ‘ভালো জিনিস জগতে কম বলেই তা ভালো, নইলে নিজেরই ভিড়ে হয়ে যেতো মাঝারি।’ ভিড় আরো বাড়তে থাকলে মাঝারি থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই পরিমাণ নয়, মানের দিকেই দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে যারা কবিতা লিখেন তাদের একটি সুবিধা হলো মুহূর্তেই সেটা ছড়িয়ে দিতে পারেন ভার্চুয়াল পাঠকের কাছে। পাঠক অনেক সময় না পড়েই কিংবা পড়লেও না বুঝেই লাইক-কমেন্ট দেন। কবি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। প্রসববেদনা ছাড়াই প্রসব করতে থাকেন অসংখ্য কবিতা। কিন্তু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না হলে খাঁটি কবিতার জন্ম হয় না।
অনলাইনে গ্রুপ করে কবিতাচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেকে। গ্রুপে কোনো সদস্য কবিতা পোস্ট করলে অন্যান্য গ্রুপসদস্যগণ লাইক-কমেন্ট করাকে সামাজিক দায়িত্ব মনে করেন। অনেকে আবার এসব গ্রুপের অসারতা বুঝতে পেরে গ্রুপ থেকে বের হয়ে যান। যারা বের হয়ে যান তাদের সংখ্যা কম। কবিতার সঙ্গে কবির আকর্ষণীয় ছবি যুক্ত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায় অনলাইনে। কবিতা নয়, কবিকে দেখেই পাঠক তুষ্ট হন। কবি এগিয়ে যান, কবিতা পেছনে পরে থাকে। ফলে ভার্চুয়াল জগতে কবি বেশি, কবিতা কম। কবিতা কম মানে মানসম্পন্ন কবিতা কম। মানহীন কবিতা বেশুমার। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রিন্ট মিডিয়ায় কি মানহীন কবিতা বা মানহীন সাহিত্যকর্ম প্রকাশ হচ্ছে না? হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবেই হচ্ছে। কিন্তু এ লেখা যেহেতু অনলাইন সাহিত্য নিয়ে তাই সঙ্গত কারণেই প্রিন্ট মিডিয়ার কথা বলা হচ্ছে না।
বর্তমান বিশ্ব ভার্চুয়াল। এই ভার্চুয়াল বিশ্ব ক্রমশ পেপারলেস হচ্ছে। আমার পিএইচডি গবেষণাকর্মের সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. স্বরোচিষ সরকার বলতেন, এখন যারা কলম দিয়ে কাগজে লিখেন তারা নিরক্ষর আর যারা আঙ্গুল চেপে স্কিনে লিখেন তারা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। কথাটি অনেকটাই প্রতীকী। আক্ষরিক অর্থে সত্য না হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ- এর এই যুগে তাই অনলাইনকে বর্জন করা সম্ভব নয়। তবে অনলাইনে যারা লিখবেন তারা অবশ্যই মান নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, অনলাইনের লাইক-কমেন্ট সাহিত্যের উৎকর্ষতা বিচারের যথার্থ মানদ- নয়। শত শত লাইক-কমেন্ট পাওয়া মানহীন হাজার হাজার কবিতা একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। আবার মানোত্তীর্ণ অনেক কবিতা লাইক-কমেন্ট ছাড়াও টিকে থাকবে। এটাই সাহিত্যেও বাস্তবতা। এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে পরিমাণ নয়; মানের দিকেই মনোযোগী হওয়া জরুরি।
শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ
ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks