রবিবার, ৪ জুন, ২০১৭

লোকটা - তাসরুজ্জামান বাবু

লোকটা

সেদিনের ঘটনাটি মনে পড়লে আজও শরীরটা কাঁটা দিয়ে ওঠে । এর কোনো ব্যাখ্যা আজ অবধি খুঁজে পাইনি। 
এক বছর আগে আমি একটা কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করতাম। রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে ঘটেছিল ঘটনাটি । কয়েকদিন পর ঈদ বলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা দোকান খুলে রাখা হত । 
সেদিন রাত এগারোটার দিকে মালিকের ছেলে দোকানে এসে বলল, ‘বাবা ! দাদীর অবস্থা ভালো না!’ 
মালিকের আম্মা কয়েকদিন থেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন । ছেলের মুখে এ কথা শুনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন । 
আমাকে বললেন, ‘নাসির, দোকান বন্ধ করে দেব নাকি?’ 
আমি বললাম, ‘অনেক কাস্টমার আসবে । আমি তো আছিই, আপনি চলে যান ।’ 
তিনি বললেন, ‘ভয় করবে না তোর?’ 
‘নাহ্, কীসের ভয়?’
‘আচ্ছা, তাহলে থাক । অবস্থা ভালো হলে আমি চলে আসব ।’
‘আচ্ছা !’
দোকানটা ছিল হাটের মধ্যে  । আশে পাশে আর কোনো দোকানপাট ছিল না, শুধু কাঁচাবাজার বসত। কিন্তু সন্ধ্যার কিছু পরেই কাঁচা বাজার শেষ হয়ে গেলে শুধু আমাদের দোকানটাই খোলা থাকত । এমনি সময় বিক্রিবাট্টা যেমনই হোক, ঈদের মৌসুমে ভালোই চলত দোকান । এমনিতেই ভয়ের কোনো কারণ ছিল না । কিন্তু মালিক যাবার পাঁচ মিনিট পরেই আমার সব ইন্দ্রিয় কেন জানি সজাগ হয়ে উঠল । ভাবলাম, দোকানে ক্রেতা নেই বলেই হয়তো একাকিত্ব আমাকে পেয়ে বসল । গ্রামাঞ্চলে রাত ১১ টা মানে অনেক রাত । আজ ক্রেতা একটু কমই, মনে মনে এসব ভাবছিলাম আমি । 
হঠাৎ মনে হল, দোকানের আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে । আমি জোরে হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে?’
আমার গলাটা কেঁপে উঠল , কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম মনে হয় ।
সাথে সাথে দেখি লোকটা চোখের পলকে দোকানের সামনে চলে এসেছে । 
‘আমার একটা কাফনের কাপড় দরকার ।’ জড়ানো গলায় লোকটা বলল ।
আমি স্বাভাবিকভাবে তার প্রয়োজনমতো কাপড় কাটতে লাগলাম । একবার মাত্র লোকটার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলাম । কুকুরের চোখের মতো জ্বলছিল চোখদুটো । ‘সামান্য একজন ক্রেতাকে দেখে আজ এত ভয় পাচ্ছি কেন আমি?’,  মনে মনে নিজেকে  প্রচন্ড ধিক্কার লাগালাম । চেষ্টা করলাম লোকটার সাথে ফ্রি হবার । কিন্তু যাই জিজ্ঞেস করি লোকটা কাটা কাটা জবাব দেয় । 
‘আপনার নাম কী?’ জানতে চাইলাম ।
‘ফজলুর রহমান ।’
‘থাকেন কোথায়?’
‘কাশিয়াডাঙ্গা ।’
‘আপনার আব্বার নাম?’
‘বজলুর রহমান ।’
পিতার নাম বলার পরেও লোকটাকে আমি চিনলাম না । লোকটা চলে যাওয়ার সময় আমি পেশাদারি বিদায় জানাতে হাত বাড়িয়ে দিলাম ।  মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘ওকে, থ্যাংক ইউ! আবার আসবেন ।’ লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল এমনভাবে যেন আমার হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা তার পছন্দ হয়নি । আমি তার শীতল চাহনীতে শিউরে উঠলাম । হাতটা ফিরিয়ে নিতে যাব এমন সময় সে আচমকা আমার হাতটা চেপে ধরল । আরো একবার শিউরে উঠলাম, কারণ লোকটার হাত বরফের মত ঠান্ডা!
আমি তাড়াতাড়ি হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই লোকটা চলে গেল । অন্যদিন এত রাতেও প্রচণ্ড ভীড় থাকে । আর সেদিন যেন লোকজন আসছিলই না । আমার ঝিমুনি এসে গেল । হঠাৎ একদল লোকের গলা শুনতে পেলাম । ঝিমুনি ছুটে গেল । লোকগুলো বলল, ‘ভালো কিছু কাফনের কাপড় দেখাও তো বাবা ।’
আমি নব্বই, একশো আর একশো বিশ টাকা গজের কাফনের কাপড় তাক থেকে ফেলতে ফেলতে বললাম, ‘আজ কত মানুষ মরছে!’
‘কেন? আর কেউ মরেছে নাকি?’ একজন বলল । 
‘জ্বী । একটু আগেই আরেকজন এসেছিল ।’
আমার খুব অবাক লাগল একটু আগে লোকটা যে পরিমাণ কাপড় নিয়ে গেল এরাও সে পরিমাণ কাপড় কাটতে বলল দেখে । 
বললাম, ‘আপনারা কোত্থেকে এসেছেন ভাই?’
‘কাশিয়াডাঙ্গা ।’ একজন জবাব দিল । 
আরো একবার চমকে ওঠার পালা আমার । 
‘মৃতের নামটা জানতে পারি?’
‘ফজলুর রহমান। কেন বাবা, চেন নাকি তাকে?’ লোকটা বলল । 
ততক্ষণে আমার হার্টবীট বেড়ে গেছে । কোনো রকমে বললাম, ‘জ্বী-জ্বী না । এমনি । বা-বার নাম কী তার?’
‘বজলুর রহমান । কিন্তু তুমি অমন করছ কেন? অসুস্থ?’ 
লোকটা আরো কীসব বলল । কিন্তু আমার কান তখন ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে সড়সড় করে ।
প্রচন্ড আতংক গ্রাস করল আমাকে । তবে কি একটু আগে লোকটার আত্মা এসেছিল আমার কাছে? নিজের কাফনের কাপড় নিজেই কিনে নিয়ে গেল! এই কথা কি বিশ্বাস করবে এরা?
আমি সেই আত্মার সাথে কথা বলেছি! চোখে চোখে তাকিয়েছি! হ্যান্ডশেক করেছি! 
ওমাগো... আমি আর ভাবতে পারলাম না । কখন যে দাঁত কপাটি লেগে পড়ে গেছি বলতে পারব না । জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি লোকগুলো দ্বিধান্বিত চোখে আমার দিকে ঝুঁকে আছে । 
তারপর থেকে আমি সেলসম্যানের চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছি । 

লেখকঃ সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলী, বাংলাদেশ রেলওয়ে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন