সোমবার, ১০ জুলাই, ২০১৭

প্রবন্ধঃ পদ্য ও গদ্যছন্দের পার্থক্য - সালু আলমগীর

পদ্যগদ্যছন্দের পার্থক্য

আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না কোনটা পদ্যের ছন্দ, কোনটা গদ্যের ছন্দ। কেউ কেউ অন্ত্যমিলকেই পদ্য মনে করেন। আর অন্ত্যমিল ছাড়া হলে তাকে গদ্যকবিতা ধরেন। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে,অন্ত্যমিলের সাথে এই ধরনের ভাবনার কোনো সম্পর্ক নাই। অন্ত্যমিল একধরনের শব্দালংকার। যা পদ্যেও ব্যবহৃত হয়,গদ্যেও ব্যবহৃত হয়। আবার এদের ছাড়া গদ্যছন্দ যেমন লেখা যায় তেমন পদ্যও লেখা যায়। এতক্ষণে অন্ত্যমিলের বিষয়টা নিশ্চয় পরিষ্কার হয়েছে। এবার চলেন পদ্য ও গদ্যের মূল পার্থকের দিকে হাঁটি।
আমরা যদি খেয়াল করি তবে দেখব,পদ্যের ছন্দ প্রকাশিত। আর গদ্যের ছন্দ অপ্রকাশিত।
যদি জিজ্ঞেস করি,কীভাবে প্রকাশিত? তাহলে উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখব: পদ্যছন্দে চরণগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট পর্বে ভাগ করা থাকে এবং যে পর্বগুলো যতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর তালে তালে পড়তে গেলেই তখন পদ্যছন্দ প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
অক্ষরবৃত্ত(পয়ার):
মহাভারতের কথা/অমৃত সমান//(৮+৬)
কাশীরাম দাস কহে/শুনে পুণ্যবান//(৮+৬)
মাত্রাবৃত্ত:
"এই খানে তোর/দাদীর কবর/ডালিম গাছের/তলে
(৬+৬+৬+২)
তিরিশ বছর/ভিজিয়ে রেখেছি/দুই নয়নের/জলে।"
(৬+৬+৬+২)
স্বরবৃত্ত:
বাঁশবাগানের/মাথার উপর/চাঁদ উঠেছে/ওই
(৪+৪+৪+১)
মাগো আমার/শোলক বলা/কাজলা দিদি/কই
(৪+৪+৪+১)
[(/) চিহ্ন দিয়ে মধ্যযতি, (//)পূর্ণযতি বোঝানো হয়েছে]
কিন্তু গদ্যছন্দে এইভাবে শৃঙ্খলা অনুসারে সমান মাত্রার পর্ববিন্যাস করা হয় না। 
★পদ্যের পর্বগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় শ্বাস ও ঝোঁকের উপর ভিত্তি করে। যা নিয়ন্ত্রণ করে যতি। 
★কিন্তু গদ্যছন্দে বাক্যাংশ বা পর্বগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থের উপর ভিত্তি করে। যা নিয়ন্ত্রণ করে ছেদ। 
★★এটাই পদ্যছন্দের সাথে গদ্যছন্দের মূল পার্থক্য। 
(মনে রাখতে হবে:যতি ও ছেদ দুটোর অর্থই বিরাম বা বিরতি হলেও,ছন্দে এ দুটো আলাদা অর্থ বহন করে।) 
নিচে ছেদ দিয়ে কীভাবে গদ্যছন্দের চরণ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তা দেখি:
ছেলেটার বয়স হবে*বছর দশেক,*
পরের ঘরে মানুষ,*
যেমন*ভাঙা বেড়ার ধারে আগাছা*--
মালীর যত্ন নেই,*
আছে*আলোক বাতাস বৃষ্টি*
পোকামাকড় ধুলোবালি*-- 
কখনও ছাগলে দেয় মুড়িয়ে,*
কখনও মাড়িয়ে দেয় গোরুতে,*
তবু মরতে চায় না,*শক্ত হয়ে ওঠে,*
ডাঁটা হয় মোটা,*
পাতা হয় চিকন সবুজ**।।
.
[* দিয়ে উপচ্ছেদ, ** পূর্ণচ্ছেদ বোঝানো হয়েছে।]
আমরা উপরে দেখে এসেছি, বিশেষ মাত্রাবিন্যাসের কারণে পদ্যে তরঙ্গের মতো এক ধরনের ধ্বনির সৃষ্টি হয়। আচ্ছা এমন যদি হয়,মাত্রাবিন্যাসের বন্ধন মানলাম না,আবার পদ্যের ধ্বনিভঙ্গিও রক্ষা করলাম। তাহলে কী হবে? তাহলে একধরনের স্পন্দিত গদ্যের সৃষ্টি হবে। মূলত এই স্পন্দিত গদ্যকেই আমরা ডাকি গদ্যছন্দ।
তবে মাত্রাবিন্যাসের বন্ধন এড়ানোর জন্য পয়ার থেকে গদ্যছন্দের ক্রমবিকাশ উপলব্ধি করাটা খুবই জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন