সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮

বই আলোচনাঃহর্সলুক পার্লার : এক অন্ধ রাখালের অনঙ্গ ঘোড়া ।। রাত উল আহমেদ


হর্সলুক পার্লার : এক অন্ধ রাখালের অনঙ্গ ঘোড়া

আপাতদৃষ্টে কবি সামতান রহমানকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একভাগ 'অন্ধ রাখালের চোখ', আরেকভাগ 'হর্সলুক পার্লার'। সঙ্গতই অন্ধ রাখালের চোখ কতখানি ঘোড়া পায়, তা দেখার ভেলকি খোলা হয়েছে 'হর্সলুক পার্লার'এ । উল্লেখ, 'অন্ধ রাখালের চোখ' সামতান রহমানের প্রথম কবিতাগ্রন্থ । আলোচ্য বিষয় পরেরটা । কিন্তু না বললে নয় যা, তা হল, তাঁর কবিতার বাউন্সি শব্দবলগুলো ওপর থেকে ভেসে ভেসে যেভাবে রিভার্স করে, সেভাবে বৌদ্ধিক তাড়নাও ধরে ধরে ঘুরায়, পা উঠালেই তাকে ষ্ট্যাম্পড্ । আজব। তাকে দিব্যদর্শন করতে চাইলেও কিছুক্ষণের জন্য দিবাচোখ নিশিবর্ণ করে নিলে সুবিধা হবে। স্বশব্দ ভাঙা গড়ার খেলায় 'অন্ধ রাখালের চোখ' কবিতাগ্রন্থের ছয় আনা রাখাল আর ছয় আনা বাউলিয়ানার মধ্যমিলে ষোলাআনা প্রণব। কিছু মন্ত্র থাকে, যার পাঠেই শক্তি । তর্কাতীত থেকেও সংশ্লেষী। বর্ণনার বাইরে থেকেও বহির্মুখী । "অন্ধ রাখালের চোখ" সেই তন্ত্রের দিকে অভিক্ষেপ করে। 

যদিও সব বিশেষণ মিলে পারস্পরিক সমার্থ করলে চিত্রহীন কল্পময় দর্শনের এক বিশেষ সামতান রহমানের দিকে যায় । বাঁশি নাই যেন, তারই সুর। ছবি নাই যেন, তারই চলৎ। একটা কবিতাবই কেবল বইই নয়, কবিও। একজন কবি কেবল কবিই নন যে, ব্যক্তিও। এটা কবিরও মনে থাকে । না হলে তার অবচেতন অংক কষে কষে অংক অস্বীকার লিখবেন কিকরে । 'অন্ধ রাখালের চোখ'এ তাই কিভাবে কবি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠেন তা আঁচ করতে চাওয়ার বই ।  

২.
আলোচ্য বিষয় স্থায়ী বা অস্থায়ী লুক না। ঘন ঘন রূপবদলের আশ্চর্য কিতাব 'হর্সলুক পার্লার' । পাঠমাত্রই পাশের প্রায়লুকারদের পরামর্শ দিতে চাইবে, কোনো প্রকার সার্জারি ছাড়াই চেহারা পরিবর্তন করতে চাইলে যেতে হবে 'হর্সলুক পার্লার' । তিন পদক্ষেপে গিয়ে ফেরা যেতে পারে আড়াই পদক্ষেপে ।  
বাকি পদক্ষেপটুকু কোথায়? পকেটে পথ রেখে চলাচল হাতড়াতে থাকবেন । 
.
বইটি পাঠের সপ্রধান আনন্দ হল, এর সর্বাঙ্গীকরণের সম্মোহনীয়তা। এটি কোনো মেলোড্রামা বা প্রহসন না। নির্মেদ ভাষিক বুনটে প্রতিটি অধ্যায় গল্প হিসেবে যতটা উপভোগ্য, উপন্যাস বা চলচ্চিত্র হিসেবে পড়তে চাইলেও ততোটাই টানটান । নতুন শ্বাস-প্রশ্বাসমালার কড়া ফোঁড়ন কাটবে । কাব্যকৌতুক হিসেবে পাঠ করতে থাকলেও স্তবকে স্তবকে গদফাটা বুদ্ধিহাস্যরসে জারিত হওয়া যায় । আবার বইয়ের কোথাও এমন তথ্য নেই যে, প্রচুর গুঁতোগাঁতালি প্রবন্ধ হিসেবেও পড়া যাবেনা। বইটা শুধু কবিতায় আটক থাকবে, তা আমিও চাইনি। মূলত হর্সলুক পার্লার কেবল সাহিত্য নয়, 'সাহিত্য রাজনীতির আত্নআয়নাও । যাতে নিজের মুখও ছাড় পায়না । বইবিমুখ যারা, তাদের জন্যও আছে কৌতূহল উদ্রেককর প্রবেশ দরজা । শুরুর অভিশ্বাসটাই যেমন--

"রেসের দশটাই যদি গাধা হয়, যেটা প্রথম হবে, সেটাও এক গাধা।'

এইটুকু পাঠের পর শরীর থেকে গাধা ছাড়ানোর জন্য পুরোটা শেষ করতে চাইবেন। 

অসাধু প্রতিযোগের এই যুগে এইরকম বোধই তো টনক তুলে দেখাবে, কার কতটুকু ঢাকা আছে, কার কি টা ফাঁকা। 
অভিনব অথচ অকৃত্রিম ভাষাবোধভঙ্গিতে লিখিত গ্রন্থখানায় সাধারণ, অসাধারণ, লেখক, অলেখক, অপলেখক-- সব ধরণের পাঠকের জন্য রয়েছে এপিসোডের পর এপিসোড টান টান উত্তেজনা উপভোগ করবার টাট্টু সুযোগ । দ্বিধাহীন বলতে পারি, "হর্সলুক পার্লার" বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের অনন্য সংযোজন । ম্যাগনিফায়ার ধরে দেখলে হয়ত দুএকটা দোষত্রুটিও ধরা যেতে পারে, 'আরও ভালো হতে পারত' টাইপের কিছু বলা যেতে পারে। আসলে কিছু সৃষ্টি আছে যা দোষগুণের ঊর্ধ্বলোক পায়। হর্সলুকের অভিনবত্ব আর সর্বাঙ্গিকরণের বিরাটত্বের কাছে 'আরও ভাল হওয়াটা' নস্যি । 
.
বলা ভালো, জর্জ আরওয়েল তার 'এনিমাল ফার্মে' যে বক্তব্য, ভাষা, ভঙ্গী, পটভূমি, চরিত্র ব্যবহার করেছিলেন, তার থেকে স্বতন্ত্র 'হর্সলুক পার্লার'এর একটা জায়গায় মিল হলো, পশু চরিত্রের উপস্থিতি । মানুষও তো প্রাণী । তাহলে মানুষ নিয়ে এত এত সাহিত্যকলা যে, তা তো বহু লেখকের এক সৃষ্টিই বলতে পারি। অরওয়েল থেকে তাঁর 'হর্সলুক পার্লার' স্বতন্ত্র, অত্যাধুনিক ও বাংলা এত যে, হর্সলুকের মত এত আগুনে আয়োজন সহ এমন বিস্ফোর শব্দাইডিয়াও ছিলনা । পশুতে পশুতে কথা বলার আইডিয়া তো তারও আগের । ক্ল্যাসিক। সেটা বাংলা ভাষাতেও কমবেশি আছে। বরং এভাবে বলতে পারি, সামতান যে মিথ সৃষ্টি করলেন তা দুর্বোধ্য না অথচ দুর্ভেদ্য । তা গদ্যের পক্ষে হোক আর গদ্যের বাইরে কবিতার পক্ষে হোক ।  

.
অধ্যায় এবং পর্বে পর্বে বিভাজিত কবিতাগুলো একটা বিন্দু থেকে সরল বৃত্তের বিভিন্ন পট ও দিক নির্দেশক হলেও সবগুলো মিলে একটা কবিতাখ্যান । 'অন্ধ রাখালের চোখ' কিছু মন্ত্রের একক, 'হর্সলুক পার্লার সেখানে মন্ত্রবান। বানগুলোর প্রক্ষেপণগুলো তীব্র, তীক্ষ্ণধার, উন্নত কমেডির সারসিয়তায় হাজির হয়েও ভাষাকে ইচ্ছামাফিক আছড়ানো হয়েছে, রগড়ানো হয়েছে, কাটাছেঁড়া হয়েছে, বাঁধাইও হয়েছে । নিছক চটুল কমেডি না হয়েও রাজনৈতিক জীবনবোধের মরমখাসা কৌতুকরস । ময়দার খামির ছানার মত করে ভাষাকে, সময়কে, ভামদেরকে দুহাতে পলিশ করেছেন। যে সকল শব্দ বা শব্দবন্ধগুলো আমরা প্রাত্যাহিক জীবনে উচ্চারণ করে ফেলে দিই, সেইসব তুচ্ছ ও অতিব্যবহারিক ডাম্পিং শব্দগুলোকে এত হিসেবি করে নির্মাণ-বিনির্মাণ করে তুলেছেন, আর কে, কোন বইয়ে, জানা নাই ।  


উত্তরাধুনিকের পরের আধুনিককে আমি বলি অত্যাধুনিক। সামতান রহমান সেই কালখন্ডেরই বহমান কবি । 

রচনাকালে লেখাগুলোতে এতই জড়িয়ে গিয়েছিলাম, কবিকে বলেই ফেলেছি দুএকবার যে, হর্সলুক পার্লার সাহিত্য ছাপিয়ে সার্বিক জীবনবোধ হয়ে উঠুক। মূলত এই বইটি আমাদের সাহিত্যরাজ্যের ব্যাঙেরছাতার মত গজে ওঠা প্রাসাদকূটের সমালোচন, পরিপার্শ্বের সমালোচন, দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচন । এমনকি সাহিত্য পরিবেশের সমালোচন করতে গিয়ে বিদেশি ভামধারীকেও চিনিয়ে দিতে চান । এদিক থেকেও 'হর্সলুক পার্লার' ও তাঁর লেখক আন্তর্জাতিকও হয়ে ওঠেন। 

অন্ধ রাখালের ঘোড়া দৌড়তে দৌড়তে উড়ুক, তাকে সর্বাঙ্গিকরণের সাহিত্য সংঘোৎ এর জৌলসে তীব্র অবতরণের স্বাগত জানাই। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন