মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

গল্পঃ যদি ।। রওশন রুবী



যদি (১ম পর্ব
মুরাদ নৌকায় উঠে বসে। উঠছে অনেকই ওপাড়ে যাবার  আর কোন বাহন নেই বলেই। আধঘন্টা পরপর ইঞ্জিন চালিত একটি, পনেরো মিনিটের পরপর একটি করে বৈঠা নৌকা যায় এঘাট থেকে ওঘাটে। কেউ কেউ একাই ভাড়া করে নৌকা নিয়ে চলে যায় অপেক্ষার চেয়ে টাকার মূল্য কম তাদের কাছে। নৈমিত্তিক যে যাত্রীরা পারাপার হয় তারা গ্রামের অতি সাধারণ সল্প আয়ের মানুষ। কখনও সখনও বড় লোকও তাদের সাথে ওপাড়ে এক নৌকা করে পারাপারে সাঙ্গী হয় । দূরের ছোট ছোট দেখতে লাগা গাছ, প্রাণী, ঘরবাড়িগুলো দেখছে মুরাদ। ছোট বেলায় মনে হতো ওরা পেছনে দৌড়ায়। মাথায় ফুল পাতা দিয়ে মাথার পেছনে হাত নিয়ে যেমন নাচতো যাত্রাপালার ফুলমতি। ডুবে যেত মগ্ন পারাবারে সেই নাচ দেখতে দেখতে, তেমনি ডুবে যাচ্ছে মুরাদ এই ডুবে যাওয়ায় শৈশব কৈশোর মাখা একটা গন্ধ আছে। শৈশব মাখা কত কত দিন শেষে তারপর জেনেছে গাছ ঘরবাড়ি কিছুই নড়ে না নড়ে শুধু নৌকটাই তাই অমন লাগে।একদিন নাবিলা বুবু কথাটি বুঝিয়ে ছিলো। বড় মামার ছোট মেয়ে নাবিলা'বু। এই নাবিলা'বু ছিলো নদী পাড়ের দৃশ্যের মত বহুরহস্যে ঘেরা । যার রহস্যগুলোর জটলা খুলতে খুলতে বছরের পর বছর এই নদীর জলে বৈঠা ঠেলেছে নাবিলা বুবুকে নৌকার পাটাতনে বসিয়ে । বুবু খুব ভালো নাচতে পারতো যা বাড়ির কেউ জানে না । যখন তারা বেড়াতে আসতো নৌকা করে আর নৌকা পাড় থেকে বহুদূর চলে যেতো তখন মুরাদকে গান গাইতে হতো । সেই গানের তালে তালে নাবিলা'বু অঙ্গ দোলাতে দোলাতে নাচ শুরু করে দিতো। নদীর উপর এমন পরীর মত মেয়ের নাচ দেখে ভীষণ মজা পেত মুরাদ।  একদিন নাচতে নাচতে নাবিলা'বু ওর গায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়লো। পড়ে তো পড়েই রইল। আর উঠেনা। মুরাদ ও নড়ে না, কি জানি হাত পা নাড়ালে নাবিলা'বু যদি দুঃখ পায়। একটু পর তিনি ফিসফিস করে মুরাদকে বললো "আইজ ঘাটে নিস না নাও।" নাবিলা'বুর সেই অবুঝ অবুঝ আচরণ আজকাল ঘুমাতে দেয় না মুরাদকে। কত বছর আগের কথা তবু জেগে উঠে দমকা হাওয়ার বেগে প্রথম নারীর ছোঁয়া। প্রথম চুলের মেথির মিহি গন্ধ পুড়ে যায় গহীন থেকে গহীনে । কি শক্তি এই নারীর যে বলবান মুরাদকে দলিত মথিত করে ফেলে। নিশ্চয়ই এই শক্তি ঐশ্বরিক। নাবিলা'বুকে দেখেনি কতবছর। অবশ্যই তার কথা শুনে দুদিনের জন্য আসবে শশুরবাড়ি থেকে। অনেক অনেক কথা জমে আছে । সব বলবে সংঙ্কোচহীন । শুনে ভালো লাগবে নাবিলা'বুরও। এবার তাকে নিয়ে  নৌকায় পাড়ি দিবে দূর দূরান্ত । গানের পর গান গাইবে, আর চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া  নদীর বুকে নৌকার গুলুইয়ে বসে নাবিলা'বুর পরীর মত দেহ দুলানো নাচ দেখবে। নাচতে নাচতে মুরাদের গায়ে উপুড় হয়ে পড়লে তখনও মুরাদ গান থামাবেনা। পুরো রাত নাবিলা'বুর চুলের মেথির গন্ধ মুরাদের যৌবনকে ছিবড়ে  ছিবড়ে খাবে।  

            নাড়ির টান বলে একটা কথা আছে। জন্মের পর যেখানে নাড়ি পোতা হয়েছে সেই মাটি নাকি মানুষকে বার বার টানে। মুরাদের নাড়ি পোতা রয়েছে তার নানাবাড়ি শ্যামাগ্রামে।  বাঘমারা জেলার একটা ছোট্ট গ্রাম শ্যামাগ্রাম। জন্মের পর শৈশব কৈশোরের অনেকটা সময় কেটেছে সেইখানে। এরপর জীবনের এতগুলো বছর পার হয়েছে কিন্তু কেন জানি শ্যামাগ্রাম মুরাদকে  আজও সেই ভালোলাগা শৈশব কৈশোরের মতই টানে। মুরাদের মন যখন কোনো কারণে খুব অস্থির থাকে মুরাদ তার এই নাড়িপোতা প্রিয় গ্রামের কথা ভাবলেই  অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করতো। মামাদের উঠোনের শেষমাথায় দুইশো বছরের পুরানো তেতুলতলার নীচে মাচানে বসে রাতের পর রাত মায়ের কথা ভাবতো। মা কি করছে পূবপাড়ার এখলাস মুন্সির বাড়িতে। মা কি তার কথা ভাবে? মায়ের কি কষ্ট হয় তাকে দেখছে না বলে? দুধভাত খুব পছন্দ ছিলো মুরাদের সেই দুধভাত মেখে মা কি গুমরে গুমরে গোপনে কাঁদে? কাঁদে আর মনে মনে ডাকে আয় আয় খোকা খেয়ে নে, খেয়ে নিলে তোরে মা বেঙ্গমাবেঙ্গমীর গল্প শুনাবো। সেই লোভে লোভে দুধভাত খাওয়া পলকেই শেষ করত মুরাদ।  জন্মের সাতমাস আগে ঘূর্ণিঝড়ে গাছচাপা পড়ে বাবা মরে গেল,জন্ম নেবার দু'বছরের মাথায় মাকে বিয়ে দিলেন নানা ও মামারা মিলে পূবপাড়ার এখলাস মুন্সির কাছে। এখলাস মুন্সির বাড়বাড়ন্ত সংসার, জমিজিরাতের হিসার নিকাশ রাখবার জন্যও একজন বিএ পাশ পি এ রেখেছেন। সেই বাড়ন্ত সংসারে মুরাদের মা তিন নম্বর বউ। সংসার ফেলে মাঝে মাঝে তিনি এসে দু'চারদিন থাকতেন মুরাদের সাথে । ধীরে ধীরে মুরাদ বড় হয় তখন ঐ দু'চারদিনের জন্য কাছে পাওয়া মায়ের বুকে পড়ে পড়ে ঘুমাতো আর মাটির গন্ধ নিতো। সেই ভালোবাসার গন্ধ সন্ধ্যামালতির গন্ধের মতো ছিলো। ঐ তেতুল গাছটি আজো আছে তো? এই গ্রামে ছেলেবেলায় দেখেছে প্রতি বছর গ্রামের সাথে লাগানো বিলে বন্যার পানি ঢুকতো। নৌকায় হৈ হৈ করে ঘুরতো মামাতো খালাতো ভাই বোনেরা সেসময় একসাথে। ছিপ ফেলে মাছ ধরতো জলভরা বিলে। অনেক বছর পর এখন সেই বিলে পানি ঢুকে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গ্রাম।

 নৌকায় প্রায় ভরে গেছে লোকজন। আধঘন্টাও শেষের পথে। একটু পর প্রিয় নদীর জল নৌকা তলায় ঢেউ তুলবে, মোহময় ঢেউ। বসার জায়গা নেই বলে দাঁড়িয়েও আছে অনেকে। ইঞ্জিনে স্টাট দিলো হারাণ মাঝি।
একদিন দুপুরে নদীর ঘাটে শিমুল গাছের শেকড়ে বসেবিড়ি টানছিলো হারাণ মাঝি। ওপাড়ে যাবার জন্য অপেক্ষারত যাত্রীরা তার পেছনে । তার পিঠ বেয়ে গলার দিকে হেঁটে যাওয়া লাল বিছাটার দিকে তাকিয়ে আছে অনেকেই । কিন্ত  কেউ কিছু করছেনা। ওটি আরো উঠে গেলে সরু একটি ডাল নিয়ে মুরাদ ওটিকে দূরে ফেলে দেয় । হারাণ মাঝি টের পেয়ে মুরাদের সহানুভূতির জন্য তাকে দোয়া করেন।  সেই থেকে নদী পার হতে কখনও মুরাদের পয়সা নিতে চাইতো  না সে। মাঝে মাঝে একাই নদী ভ্রমণ করতো মুরাদ। হারাণ মাঝির নৌকাই ভাড়া নি তো তারা। তার পরিবার চলতো তার একার আয় দিয়ে। তাই মুরাদ সবসময় চাই তো ভাড়াটা দিয়ে দিতে। তিনি বছরের যে ছয়মাস বিলে পানি থাকে সেই ছয়মাসই নৌকা চালাতেন । কারণ তার মনে হতো শুধু নদী পারাপারে সংসার চলবে না। বিলে পানি থাকলে নদী পারাপারের সাথে বিলে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে ভালো পয়সা পাওয়া যাবে । রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই একসাথে হলো তবে। তাই তিনি ছমাস নৌকা চালান, বাকি ছয় মাস বাঁশের তৈরি ডালি,কুলা, চাঙারি ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র বিক্রি করে চলতেন। মাঝে মাঝে পূবপাড়ায় গেলে মায়ের খবরও তাকে এনেদিতো।

দ্বিতীয় অংশ


মা তার জন্য লুকিয়ে একটা দুটো সৃজনীফল, পিঠা ইত্যাদি দিতো। হারাণ মাঝির কাছ থেকে এসব নিয়ে খেতে খেতে ভাবতো যদি সে হারাণ মাঝি হতো তবে মাকে দেখতে পেত, জিনিসপত্র দেখাবার ছলে ছুঁয়ে দিতো মায়ের পবিত্র হাত। সেই হারাণ মাঝি এখন ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালায়। সেকি মায়ের কোন খবর বলতে পারবে এখনও? মুরাদ তার সামনে যায় সে মুরাদকে চিনতে পেরে একগাল হাসে। কিন্তু বহুক্ষণ বহুকথা বললেও মায়ের কথা সে কিছুই বলে না দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার কাছ থেকে সরে আসে। আহা অভাগী তুমি কেমন আছোগো? দূর আকাশ পানে একফালি ধূসর মেঘের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে আর ভাবে যদি ঐ মেঘ হতাম, যদি হতাম, তবে মাগো আসমানে ভেসে ভেসে তোমাকে দেখতাম ।

 মাঝেমাঝে দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিতো মুরাদ লুকিয়ে চলে যেতো এখলাস মুন্সির পুকুর পাড়ের বাগানে, সেই বাগানের বড় আমগাছের ডালে উঠে পাতার ফাঁকে লুকিয়ে বসে বসে সে মাকে দেখতো। দেখতে দেখতে তার মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করত ।ছোট মামীর কথা মনে পড়তো তখন মামী বলেছে _ মুরাদ ঐবাড়িতে যখন তোর মা থাকবে তখন তুই ঐ বাড়িতে মায়ের কাছে যাবিনা। যদি ভুলেও গেছিস্ তবে এখলাস মুন্সির দুই বউ তোর মাকে কুটিকুটি করে কেটে লবণ দিয়ে পুকুরে ফেলে দিবে।তখন তুই মা পাবি কই? মাকে তুই বাঁচাতে চাস না? মুরাদের গা শিরশিরিয়ে  উঠেছিলো। সে চিৎকার করে উঠে বলেছিল চাই চাই ---। 
তাই মুরাদের বুক ফেটে গেলেও মায়ের কাছে যেত না বরং বুকে ব্যথা হলে আমগাছের ডালে বুক চেপে ধরে রাখতো। একবার মুরাদের খুব জ্বর হয়েছিল। জ্বর সারতে সারতে ঘোর বৃষ্টি শুরু অনেদিন সেবার মাকে না দেখে সে পাগলের মত হয়ে গেছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি কমতেই দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে উঠলো সেই আমগাছে। গাছের ডালে একটা সাপ শুয়ে ছিলো । মুরাদের হাত ওর গায়ে  পড়তেই সে প্রতিবাদ করে। ব্যথা যন্ত্রণায়, ভয়ে মুরাদ গাছ থেকে চিৎকার করতে করতে পড়ে যায়। মুরাদের বিষয়টি সেবার জানাজানি হয়ে গেলে রোজার ঈদের কদিন আগে এক দূরসম্পর্কর নিঃসন্তান মামা কাছে মুরাদের লালন পালনের ভার তুলে দেন মামারা। তিনি মুরাদকে শহরে নিয়ে গেলেন । যাবার পর আর এমুখো  করেননি মুরাদকে। মুরাদের বুকের মধ্যে শুধু খৈ ফুটেছিলো গোপনে মায়ের জন্য ভালোবাসায়। একা পথ চিনে আসতে পারেনি কখনো বলেই তার মাকে দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। আজ সে প্রতিষ্ঠিত । মা চাইলে তাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবে। আর যদি না চায় তবে দূর থেকে দেখে যাবে। সে এখন
দাঁড়িয়ে যে নদীর উপর নৌকায় তা অনেক শুনশান ঠিক মায়ের মত। এক অদ্ভুত ভালো লাগা মূহুর্তে ছেয়ে গেলো শিরায় উপশিরায়। সে নদীটির কয়টি চলমান ছবি তোলা। পড়ন্ত বিকেলের ছবিগুলো বড় অদ্ভুত সুন্দর লাগে তার কাছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আকাশ ঘনমেঘে ছেয়ে আছে। নৌকাঘাট দেখা যাচ্ছে এতক্ষণে। বৃষ্টির সাথে সাথে অস্থিরতা বাড়ছে উপস্থিতির মধ্যে। যাদের কাছে ছাতা আছে প্রত্যেকে ছাতা খুলে ফেললো, রঙবেরঙের ছাতায় ভরে উঠেছে মুরাদের চারপাশ। মুরাদের ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব। মামা বাড়ি পৌঁছাতে সন্ধ্যা  হয়ে গেল। মামা মামী কেমন বুড়ো হয়ে গেছে। মামাতো দু'ভাই বিয়ে করেছে। মুরাদের আগমনে সন্তান কোলে মামাতো ভাইসহ তারাও ড্রইংরুমে উপস্থিত, নাবিলা'বু এবাড়িতেই ছিল। সে একমগ লেবুর শরবত এনে বলে " ধর খেয়ে নে, কত দূর থেকে এলি, কত বছর পর।" মুরাদ আতৎকে উঠে সেই আদর মাখা কন্ঠ, চাহনি, মায়াময় মুখ, লকলকে পুঁইডগার মত শরীর আর নাবিলা'বুর নেই। তার পরনে কালো সরুপাড়ের সাদা শাড়ি। দৌড়ে ঘরে ঢুকে দশ আর বারো বছরের দুটো ছেলে নাবিলা'বুকে জিজ্ঞেস করে " মা উনি নতুন মামা?" নাবিলা'বু খটখটে মরুভূমির মত চোখে মুরাদের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ে।  মুরাদের বিরক্ত বিস্বাদ লাগতে থাকে সব। সে সবাইকে ফেলে সেই তেঁতুল তলার দিকে হাঁটতে থাকে। পেছনে একটা মৃদু পায়ের শব্দে দাঁড়িয়ে যায়। শব্দটি সুস্পষ্ট হয়ে মুরাদের পাশে থামে এবং বিধ্বস্ত বিপন্ন মানুষের কন্ঠে ডাকে " বাবা!"  মুরাদের বুক মোচড়ায়। দি পৃথিবীর সমস্ত  সময় মুরাদ এই ডাকটা শুনতে পেত?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন