মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭

গল্পঃ একটি তাপসীর গল্প ।। মারুনা রাহী রিমি





একটি তাপসীর গল্প

ভালবাসা মানুষকে দিয়ে কি না করাতে পারে!
তাপসী এক সময় আবৃতি ও নাট্য দলের সাথে যুক্ত ছিল। আবৃতি তার এতটা ভাল লাগতো না। কিন্তু একটা ছেলেকে ভালবেসে সে কবিতাকে ভালবাসতে শুরু করলো। ছেলেটি প্রায়ই তাকে কবিতা শোনাত। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতো। কারন ঘুরে ফিরে সেই কবিতা, আবৃতি, দল ইত্যাদি ইত্যাদি। 

সময়ের সাথে ভালবাসা যত গভীর হল, ছেলেটির ভাল লাগার সেই সকল বিষয় সে আপন করে নিতে থাকল। ধীরে ধীরে তার কবিতার প্রতি আকর্ষণ বাড়ল। আবৃতি ও দলের জন্য জন্মে গেল অদ্ভুত ভাল লাগা। কাছাকাছি থাকতে ছেলেটিই তাপসীকে নানা ভাবে দলের সাথে যুক্ত করলো। 

প্রায় ৫ বছর সে মন, প্রাণ, সময়, শক্তি দিয়ে সে আবৃতি ও নাট্য দলের জন্য করেছিল। কখনও ‘উহ” শব্দটিও করে নি। এমন অনেক সময় গিয়েছিল যখন তার শরীর আর সময়ও সঙ্গ দিতো না। তবুও সে ভালবাসার খাতিরে দলকেই প্রাধান্য দিতো। বাহ্যিক সৌন্দর্য ও কণ্ঠের অসামঞ্জস্যতার জন্য খুব একটা প্রযোজনায় সুযোগ না পেলেও অন্যান্য অনেক কাজে নিজেকে একদম বিলিয়ে দিয়েছিল।

ভাগ্যে ২/১ টা ছোট খাটো প্রযোজনা করার সুযোগ হল। কিন্তু ছেলেটি আর পাশে ছিল না। কারন ছেলেটি পারিবারিক ভাবে নিজেদের গাঁয়ের কোন ধনী ক্ষমতাশীল লোকের মেয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার যাত্রায় রয়েছে। প্রেমলীলা কতদিন চলছিল জানা নেই। তবে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করেছিল।

একটি নাটকের জন্য প্রায় বছর খানেক বহু পরিশ্রম, ত্যাগ, সময়, টাকা, কষ্ট ব্যয় করে তাপসী তৈরি হয়েছিল। নির্দেশকের অনেক আশা ছিল তাপসীর সেই চরিত্রটি নিয়ে। কারন চরিত্রটি অনেক বিশেষ ধরনের এবং মঞ্চ কাঁপানোর মতো ছিল। তাপসী একদম তৈরি হয়ে গেল নাটকের চরিত্রটির জন্য।

মাত্র ২ সপ্তাহ আগে তাপসী রিহার্সালের সময় জানতে পারলো তার ভালবাসার সেই মানুষটি অন্য কারো সাথে বাগদান অনুষ্ঠানে লিপ্ত রয়েছে। মুহূর্তে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। তাপসীর মনে হচ্ছিলো সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। অসম্ভব রকমের মাথা ঘুরাচ্ছে। এরই মধ্যে তার দৃশ্য রিহার্সালের ডাক পড়লো। কাউকে কিছু না বলে চেষ্টা করলো দৃশ্যটি শেষ করতে। কিন্তু দৃশ্যটি ঠিক মত করতে পারলো না।

নির্দেশককে তাপসী অসুস্থতার কথা জানালো এবং বলল পরের দৃশ্য করার মতো শক্তি তার নেই। অগত্যা নির্দেশক তাকে চলে যাবার অনুমতি দিলেন। পুরো রাস্তা তাপসীর শুধু চোখের পানিই ঝরল। বাসায় যেতেই জ্বর এবং অনেক অসুস্থ হয়ে গেল। সে বাধ্য হয়ে নির্দেশককে বুঝিয়ে তার সমস্যার কথা বলল যাতে তিনি তাপসীর কিছু হলে বিকল্প কাউকে তৈরি শুরু করতে পারেন।

নির্দেশক তাপসীর অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারন তাকে ছাড়া নাটকটি বন্ধ হয়ে যাবে। তাপসী কয়েকদিন সময় চাইলো নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরি করতে। তবুও অসুস্থ শরীর নিয়েও সে কয়েকদিন রিহার্সাল করতে গেল ১০৩ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও। সবাই শুধু তাকে করুনার দৃষ্টিতেই দেখত যা ওর ভাল লাগতো না।

সময়ের সাথে সাথে একজন ট্যালেন্টেড মেয়ে ২ সপ্তাহের মধ্যেই তাপসীর সেই চরিত্রটি তৈরি করে ফেলল। তাপসী নির্দেশককে কথা দিয়েছিল যে, যতদিন বিকল্প না তৈরি হবে সে পাশে থাকবে। 

তাপসী আর সেই ছেলেটির এই বিষয়টা দলে জানাজানি হওয়াতে ছেলেটি নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে তাপসীকে নানা ভাবে বদনাম করে ফেলল। দল আর কি করবে। ক্ষমতাশীল, পুরাতন সদস্য হিসেবে ছেলেটির অন্যায় জেনেও তাকে সাপোর্ট করে তাপসীকে চায়ের কাপে পড়া মাছির মতো করে তুলে ফেলে দিলো। 

তাপসী মেনে নিলো যে, তাপসীদের কখনও ন্যায় হয় না। পুরুষ সে ন্যায় করুক আর অন্যায় করুক, সমাজ সব সময় পুরুষের পাশেই থাকে। সেখানে যদি সেই পুরুষ হয় ক্ষমতাশীল। তাপসীর দুঃখ ছিল না ভালবাসার মানুষটিকে না পাবার জন্য। তাপসীর কষ্টটা ছিল এই যে, বিনা দোষে ছেলেটি দলে তাকে বদনাম করে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করেছিল। আর দল সকল সত্য জেনেও তাপসীকেই দাবিয়ে দিয়েছিল। সত্যকে হারিয়ে দিয়েছিল।

তাপসীর জীবন সেখানে থেমে রইল না। একের পর এক বিপদ, কষ্ট, যন্ত্রণা, আপন হারাবার ব্যাথায় কাতর হতে থাকল। এক সময় এতিম হয়ে একা একা মায়ের সেবায় নিজেকে নির্লিপ্ত করে দিয়েছিল। তাপসী ভেবেছিল দল যদি ওকে ন্যায় না দেয় তো সে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যাবে। কিন্তু সময় তাকে বলে দিলো, সেই ছেলেটি আর তার দলের অন্যায়ের থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তার বাবা-মায়ের তাকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবা, বৃদ্ধা মায়ের স্বান্তনা, বাবার মৃত্যু ইত্যাদি। এসবের কাছে ছেলেটির অন্যায় বা দলের নোংরা রাজনীতি সম্পূর্ণ শূন্য মনে হল। তাই তাপসী গলায় দড়ি না দিয়ে তাদের পাশে থেকে তাদের বেঁচে থাকার আশ্রয় হয়েছিল।

এভাবেই আরও কয়েক বছর কেটে গেল। তাপসী হারাতে হারাতে এবং হারতে হারতে নিঃস্ব একা জীবন যাপন করতে লাগলো। এরই মধ্যে তার জীবনে এলো “রোদ্দুর”। তাপসী আর ভালবাসা বিশ্বাস করে না যদিও রোদ্দুর দাবি করে তাপসী যেমনই হোক না কেন তাকে সে ভালবাসে। তাপসী তাকে কোন উপাধি দেয় না। না বন্ধু বলে, না প্রেমিক আর না জামাই। সে তো এসবে আর বিশ্বাসী নয়।

তাপসী রোদ্দুরকে পার্টনার ভাইয়া বলে। পার্টনার বলে এই হিসেবে যে, ওদের মন মানসিকতা মিললে একসাথে পথ চলবে, কিন্তু কোন প্রকার সম্পর্কে জড়াবে না। কোথাও বিয়ে, ভালবাসা, হিংসার স্থান হবে না। তাপসীর আরও পার্টনার থাকতে পারবে আবার রোদ্দুর এরও পার্টনার বা গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারবে। কিন্তু কোন সম্পর্কের ঝামেলায় তাপসী আর জড়াতে চায় না।

সময়ের সাথে তাপসী এবং রোদ্দুর এর মাঝে গভীর পার্টনারশিপ গড়ে উঠলো যা ভালবাসা, বিয়ে, বন্ধুত্ব বা অন্য সকল মানবিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। তাপসী মনের কথা খুব একটা শেয়ার না করলেও সরলতার সাথে সে রোদ্দুরকে সময় দেয়, ভালবাসা দেয়, যত্ন করে, খুশি রাখে। এভাবেই হয়তো রোদ্দুরের মনে তাপসীর জন্য কোন এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়ে গেছে যদিও তাপসী বারবার মনে করিয়ে দেয়, “আমাদের কিন্তু এমন কোন কথা ছিল না।“

প্রতিদিন ফোনে গল্প করতে করতে একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে তারা জানতে লাগলো। এরই মধ্যে তাপসী জানতে পারলো রোদ্দুর তার সম্পূর্ণ বিপরীত। রোদ্দুরের আবৃতি, কবিতা, বই পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক পছন্দ। তার খুব ইচ্ছা একজন সফল আবৃতিকার হবে। তার এই জগতটা খুবই ভাল লাগে। এছাড়াও রোদ্দুর অনেক মেধাবী ছিল। ভাল আবৃতি করতো, অন্যের নকল করতো, সুন্দর অভিনয় করতো, সুন্দর গান গাইত, তার কণ্ঠশৈলী এবং ভাষাশৈলী অসাধারন।

তাপসী রোদ্দুরের এমন অসংখ্য প্রতিভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিজের কষ্ট হলেও সেই দলের সাথে যুক্ত হবার পরামর্শ দিলো যে দল তাকে জীবনের কোন দিন নিরাময় না হবার মতো ক্ষত দিয়েছিল। সেই সকল এলাকায় রোদ্দুরকে এলিয়ে দিলো যে সকল এলাকা সে সেদিন থেকেই পরিত্যাগ করেছিল। সে আর শিল্পকলা, শাহবাগ, কাটাবন ইত্যাদি সকল জায়গায় যায় না। কিন্তু রোদ্দুরের ইচ্ছা ও প্রতিভার জন্য নিজের ঘৃণাকে বিসর্জন দিলো।

রোদ্দুর অনেক চেষ্টা করলো তাপসীকে পুনরায় সেই জগতে নিয়ে যেতে। তাপসীর ঘৃণার কথা জেনে সেও অসংখ্যবার যেতে চায় নি। ত্যাগ করেছিল। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাপসী রোদ্দুরকে দিয়ে সেই ছেলের কাছেই কল করিয়ে সব ঠিক ঠাক করিয়ে দিয়েছিল যে ছেলেটা তার এই জগত ছারার জন্য দায়ী ছিল। 

তাপসী জানে, রোদ্দুর এই জগতের জন্য একদম পারফেক্ট। সে এই জগতে একটু শিক্ষা পেলে সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে যেতে পারবে। প্রচণ্ড মেধাবী সে। তাপসীর কি এসে যাবে? বরং সে এক সময় গর্বিত হবে এবং মরলেও বেঁচে থাকবে রোদ্দুরের কণ্ঠে, অভিনয়ে, উচ্চারনে, সফলতায়। 

নিজের ঘৃণার জন্য তাপসী তার দায়িত্ব থেকে সরে যায় নি। রোদ্দুরকে এগিয়ে দিয়েছিল তার পছন্দের সেই স্বর্ণ সিঁড়িতে যদিও ঝগড়া হলেই রোদ্দুর জিদ ধরে বলে, “আমি ওখানে যাবো না।“ আর তাপসীও তাকে বলে, “আমাকে যদি এক বিন্দুও ভালবেসে থাকো তবে এই সিঁড়িটা বেয়ে সেই স্বর্ণ শিখরে উঠে দেখাবে যেদিন আমি গর্বের সাথে বলতে পারবো কেউ একজন আমাকে সত্যি ভালবেসে সেই সফলতা অর্জন করেছে যার সে হকদার ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন