শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭

ঈদ (গল্প) - আফরোজা হীরা

ঈদ

প্রচন্ড টেনশনে রেহানার প্রেসার বেড়ে গেছে, একটা রেমেজ(২.৫) খেয়ে সে বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ আবার ওপাশ করছে । রাগে দুক্ষে তার ইচ্ছে করছে গলা দড়ি দিতে, তাইতো ! এত বড়ো অপমান! গলায় দড়ি দেওয়াই তো উচিত, তার আত্নহত্যার খবর শুনে পুলিশ এসে আরহাম'কে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়ে সোজা নিয়ে ঢুকিয়ে দেবে জেলখানায় । সেই দৃশ্য দেখে কবরে গিয়ে সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। ভাবতে ভাবতে চোখদুটো ভিজে ওঠে রেহানার। একটা দামি শাড়ি যার কিনে দেওয়ার ক্ষমতা নেই সে বিয়ে করে কেনো?

বাবার ঘরে একমাত্র মেয়ে সে, ছোটোবেলা থেকে না চাইতেই ডজনখানেক জামা পেয়েছে প্রতি ঈদে । বাবা, চাচা, মামা, খালা, ফুপু না চাইতেই সবাই জোড়ায় জোড়ায় নতুন কাপড় উপহার দিয়েছে তাকে। আর এখন আরহামের সাথে বিয়ের পর উল্টো তাকে দিতে হয় সবাইকে, সংসারে বড় বৌ হওয়ার দরুন তেমন একটা উপহার পায়না সে, বরং সবাইকে দিতে দিতে নিজের বেলায় দেখা যায় কিচ্ছু নেই। গত দুই বছর সে মুখ ফুটে কিছু বলেনি নতুন বৌ বলে। কিন্তু এবার প্রথম তারা আলাদা বাসায় নিয়েছে, এই বিল্ডিংএর সবাই অনেক দামি দামি কাপড় কিনেছে। স্বর্ণা ভাবি তো গত রাতে তার নতুন শাড়িখানা দেখাতে নিয়ে এলো, হাসতে হাসতে দামটাও জানিয়ে গেলো এক লাখ আশি হাজার টাকা। রেহানাও কৌশলে গর্বের সাথে জানিয়ে দিয়েছে আরহাম রোজার প্রথমদিনই তাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু সময়ের অভাবে এখনো মার্কেটে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।

তারপর থেকেই রেহানার মেজাজ গরম, সে জানে আরহাম এত টাকা তাকে কখনোই দিতে পারবেনা, বড়জোড় ঈদের দু’দিন আগে হাজার দশেক টাকা হাতে ধরিয়ে দেবে অথবা দাঁত বের করে খ্যেত-মার্কা একটা সস্তা শাড়ি এনে তার সামনে হাজির হবে। ভাবতেই শরীরটা তার জ্বলে যাচ্ছে, না আর নয় । কাল সকালেই সে চলে যাবে বাপের বাড়ি, কোনো রকমে রাতটা শেষ হলেই হয়।
সকালে উঠে কাপড় গুছিয়ে লাগেজে ভরে রেহানা বেরিয়ে পড়লো বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে, কিছুদূর হাঁটার পর পিছনে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালো ।
তের বছরের সালমা তাকে ডাকছে- ও খালা… ও খালা…
রেহানা থামলো, মেয়েটা তার পরিচিত । এক অন্ধ ভিখারীর মেয়ে, সপ্তাহে একদিন আসে ওর মায়ের হাত ধরে ভিক্ষা করতে। মা নিচে দাঁড়িয়ে থাকে আর সালমা ওর ছোট ভাইটার হাত ধরে ফ্লোরে ফ্লোরে ঘুরে ভিক্ষা চায় । বড় মায়া হয় ওদের দেখলে, আলাদা বাসা নেওয়ার পর অনেক খাবার বেঁচে যায়, সে প্রায় দিন সালমাকে ভিক্ষার সাথে ঐ খাবারগুলো দিয়ে দেয়। রেহানা অবাক হয়ে দেখে উচ্ছিষ্ট একটু খাবার পেলে শিশু দুটো কী যে খুশি হয় !
দরোজার সামনে দাঁড়িয়েই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয়। সেখান থেকে মায়ের জন্যও একটু বাঁচিয়ে রাখে।

কাছে এসে সালমা বলে খালা আপনি কই যান? কবে আসবেন ?
রেহানা বিরক্তির স্বরে- মরতে যাই, কেনো তোর শুনে কি দরকার?
সালমা- আমার একখান কথা ছিলো ।
রেহানা- তারাতারি বল...

সালমা- "খালা, আমারে আপনার একখান পুরোনো শাড়ি দেবেন? এবার ঈদে আমাগো বস্তির সবাই শাড়ি পড়বে । আমারও ইচ্ছে করে একখান শাড়ি পরতে, কিন্তু আমার মায়ের তো কোনো শাড়ি নেই, তাই আপনের কাছেই আইছিলাম । দিবেন খালা একখান পুরোনো শাড়ি?
মেয়েটার কন্ঠে আবদার ঝরে পড়ে ।

কথাটা শুনে মুহুর্তে মনটা খারাপ হয়ে যায় রেহানার, সে রাস্তার মাঝেই লাগেজ খুলে একটা গোলাপি রঙের জর্জেট শাড়ি বের করে তুলে দেয় সালমার হাতে ।

শাড়িটা হাতে পেয়ে সে যে কী খুশি! সালমা আনন্দে আত্নহারা হয়ে শাড়িটা এগিয়ে দেয় তার মায়ের দিকে- ও মা দেখো, খালা কী সুন্দর একখান লাল শাড়ি দিছে, কী সুন্দর গন্ধ তাতে!

অন্ধ মহিলা শাড়িটা ধরে শুঁকে দেখে ; মুখের সাথে চেপে ধরে রাখে আর তার চোখ থেকে টপ্‌টপ্‌ করে পানি পড়তে থাকে । সামনের দিকে হাত দিয়ে হাতড়াতে থাকে আর বলতে থাকে "বুবু'গো তুমি এই অন্ধের ইজ্জত বাঁচাইলে, মাইয়াডারে কোনোদিন এট্টা ভালো কাপড় দিতে পারিনি। সারাটা জীবন আমার বাচ্চাগুলো মানুষের পুরোনো ছেঁড়া জামা পইরে ঈদ করিছে।
সালমাও শাড়ির একটা অংশ নিজের মুখের সাথে চেপে ধরে রাখে।

রেহানা চেয়ে দেখে মা মেয়ে দুজনের চোখে পানি, সেই সাথে সে আবিস্কার করে তার নিজের চোখেও পানি। পা ঘুরিয়ে সে হাঁটতে থাকে পিছন দিকে, যেদিক থেকে একটু আগে বেরিয়ে এসেছিল। তার চোখের সামনে শুধু ভাসতে থাকে একটি দৃশ্য, পুরোনো শাড়িটা হাতে পাবার পর সালমার চোখে খেলে যাওয়া খুশির ঝিলিক।
রেহানা মনে মনে ক্ষমা চায় সৃষ্টিকর্তার কাছে, আর বাসায় ফিরে আরহামের কাছে...

  শিক্ষা- তোমার যা আছে তাই নিয়ে খুশি থাকো। সব সময় নিচের দিকে তাকাবে, অসহায় মানুষদের নিয়ে ভাববে, তাহলে জীবনে আর কোনো দুক্ষ থাকবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন