শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭

স্নেহ (গল্প) রওশন রুবি

স্নেহ

একটা  ব্যাপার ভুলতে পারছি না কিছুতেই।
নির্জন কৃষ্ণচূড়ার তলে বসে আছি ।
ফুল মৌসুমে ফুল ঝরতো, আগুনের মতো ফুল।এখন হাওয়া বইছে শীতল। সবভাবনাগুলো হোচট খায় ঐ একটি ভাবনাকে কেন্দ্র করে।অনমন দাগ কাটি শেকড়ে । সেই ভাবনাটাই ঘিরে রাখে।ঈদ আসছে,চলছে বৃষ্টি, একদিন রোদ উঠলেই সবাই লেগে পড়ছে রোদ ব্যবহারে, ইনুর অভ্যাস ঘরের মশারি থেকে শুরু করে পায়ের পাপোষ পর্যন্ত ধুয়ে শুকিয়ে তবেই শান্তি। এসব কাজে অফিস ছুটি নিয়ে হলেও সংসারে সুস্থ শ্বাস ফেলবার জন্য ইনুকে  সাহায্য করতে হয়। কাঠের তোরঙ ভর্তী কাপড় চোপড়, সেগুলো রোদে দেবার দিন ঠিক হলো শুক্র কিংবা রোদ বেতিড়িক হলে শনিবার।কাল ঝিরঝিরে বৃষ্টি ছিলো আজ শনিবারে আকাশে মেঘহীন ঝকঝকে রোদ বন্যা। ইনু কেন কাঠের বিশাল তোরঙটি খুলতে গিয়ে তাকে সরিয়ে দিলো সুকৌশলে? কি আছে তোরঙে ? যা তার সামনে খোলা যায় না। খাটের পাশে রাখা তোরঙের উপরের টুকিটাকি জিনিসগুলো সরানো পর্যন্ত আমি রইলাম , পরমুহূর্তে ইনু বললো শুনো ছাদে পাটিগুলো তো বিছিয়ে আসিনি যাওনা প্লিজ । আমি ততক্ষণে এগুলো বের করি ভাঁজে ভাঁজে । অথচ কথাই হলো আজ ছাদ নয় এই কৃষ্ণচূড়া থেকে ঘর অব্দি যে তারটানা আছে তাতে শুকাবে কাপড়গুলো , কারণ ছাদের কড়া রোদে ওগুলোর রঙপুড়ে যাবে।
ইনু তাকে যে ঐমুহূর্তে ঐ স্থান থেকে সরাতে চাইছে তা সুস্পষ্ট। তাই অভিমানে ছাদে না উঠে কৃষ্ণচূড়ার তলে এসে বসে রইলাম।ইনু জানালায় মুখ বাড়িয়ে কয়েকবার ডাকলো "কই শুনছো ?কি হলো তোমার? আসো না  একা হাতে এতো কাজ করবো কি করে ? " বসেই রইলাম তবু। ইনু কি বুঝলো না বুঝলো বুঝা গেলনা , ডাকও পড়লো না আর। 
একবার না বললে বারবার না ডাকলে যাওয়াও যায়না বলে গেলামনা। পাশের ঘরে নিরবে ঢুকে শুয়ে রইলাম। রোদ খাইয়ে দুপুর নাগাদ কাপড়গুলো ঘরে এলে ফের গোছাতে লাগল ইনু। দুবার এসে আমাকে দেখে গেলেও একবারও আর ডাকেনি। অথৈ তার বোনের মেয়ে পাশের ফ্লাটেই থাকে তারা। ওকে সঙে নিয়েছে বোঝা যায় । কাপড়গুলো গোচাচ্ছে আর অথৈ বকবক করছে " তুমি কি বলো তো খালামনি, এই এত্তোসব আগলে রাখার দরকার কি? অনেক বছর আগলে রেখে বোঝা বাড়িয়েছো , এবার ফেলে দাও দেখি। ঘরে এতো আবর্জনা কেন রাখো? " তোরঙে কাপড় সাজাতে সাজাতে এবার ইনু মুখ খোলে ,তবে খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে অথৈকে বলছেন " চুপ কর পাগলি ওসব তুই বুঝবিনা, নদীর সব ঢেউয়ের জন্যই নদীর মায়া সমানরে, যে ঢেউ পাড় ভাঙে আর যে ঢেউ শুধু ফিরে যায়। " ইনুর নাক টানার শব্দে বুঝা যায় ও কাঁদছে , ওর চোখে পানি এলেই নাকে চোখে সমানে পড়তে থাকে। তারপর শুরু হয় মাথা ব্যথা। আমি আর সরে না থেকে উঠে গেলাম । আমাকে দেখা মাত্র ইনু চমকে উঠে , ওর হাতে ধরা ছোট্র একটা শার্ট এদিক ওদিক লুকাতে ভেজা চোখে তাকায়, চোখ ভিজে ইনুর দুগালে লেপ্টে আছে সুরমার ধারা। ওর বিব্রত মুখটা মায়াময় লাগে। শার্টের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম ইনু কেন আমাকে তোরঙ খোলার আগে সরিয়ে দিয়েছে। সেই দশবছর পুষে রাখা রাগ চোখের কোণে টনটন করে উঠে। আজ বৃষ্টির ধারার মতো নরম হয়ে উঠলো মনের চৌহদ্দি, পাহাড় ধ্বসে পড়ার মতো পড়তে লাগলো তারপর, সেই পাহাড়ের মাটির তলে চাপা পড়তে থাকলো জীবন্ত অভিমানগুলো। অথৈয়ের আশেপাশে ছড়ানো ফারুকের আরো অনেক জিনিস। সেদিকে তাকিয়ে বিবর্ণ ইনু চট করে তোরঙে রাখা একটি শাড়ি ভাঁজ খুলে ওগুলোর উপর এমন ভাবে ছুঁড়ে ফেলে যাতে ওগুলো আমার চোখে না পড়ে। 
 মনেপড়ে যেদিন অপদার্থটা চুপিচুপি বিয়ে করে শশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকা শুরু করলো সেদিন খবরটা পেয়ে রাগে দুঃখে ওর স্মৃতি চিহ্ন মুছে দিতে সব ব্যবহারিক জিনিসপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিলাম।আর বলেছিলাম ওর নামটি এবাড়িতে কেউ নিবেনা। ওর চেহারা যেন আর না দেখি । কিন্তু মায়ের তোরঙে যে সন্তানের ভালোবাসার কতো রূপরেখা এইভাবে পড়ে থাকে তা জানা ছিলো না আমার । বড় মায়া হয় ইনুর জন্য । চোখের টনটনটা কখন বেরিয়ে এলো বুঝতে পারলামনা। খাটের পাশে বসে ইনুর শাড়িটা সরিয়ে প্রথম সন্তানের ছোঁয়া লাগা কাপড়, খেলনা, প্রথম পড়া বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি । আহ্ বুকের ভেতর ফারাক্কার বাঁধ খুলে খুলে যায় । ছোবলের পর ছোবল হানে ঢেউ। আমার বাহু স্পর্শ করে ইনু। বললাম ছেলেটা বাবার মতো জেদী হয়েছে কি বলো ? ইনু কান্না গিলতে গিলতে বলে " হুম।"
ওকে আসতে বলো , বলো যে বুড়ো বাপ তোরে দেখতে চায় ।
ইনু আর সইতে পারেনা ও  ঢুকরে উঠে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন