শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭

ফুলস্টপ (গল্প) - দেবাশিষ রায়

ফুলস্টপ

ভোটের চিঠি এলে সব অফিসে একটা হইহই শুরু হয়. কারো এলো কারো এলো না.যার এলো,কোথায় হলো? কেউ প্রিসাইডিং কেউ মাইক্রো. মোটকথা সব কাজ ছেড়ে
মুহূর্তের  মধ্যে অফিসগুলো মোড়ের চা দোকানের আড্ডায় পরিণত হয়. উত্তমের অফিসেও এর  অন্যথা হোল না. ভোটের চিঠি এসেছে শুনে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো বড়বাবুর  টেবিলে. পরীক্ষার রেজাল্ট দেখবার মত টানটান উত্তেজনা. উত্তম এককোনায় দাঁড়িয়ে  দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করছিল. আচমকাই দেখতে পেলো ভিড়টা সোজা হয়ে দাঁড়ালো. এতক্ষণ  যেটা উবু হয়ে ঝুঁকে ছিল বড়বাবুর টেবিলের ওপর, সেটা এখন টানটান সোজা। উত্তম কান খাড়া করলো. কিছু একটা হয়েছে. নইলে সবাই ওভাবে একসাথে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কেন?ঠিক তাই। আশঙ্কা  অমূলক নয়. শুনতে পেলো বড়বাবু বলছেন-এই মিসেস কালী টি কে? কোথ্থেকে এল এই নাম. ও নামের কাউকে তো এই তিরিশ বছরে আমাদের অফিসে দেখি নি. এনার নামে  ভোটের চিঠি এল কেনো এই অফিসে? হুমমম. ঠিক. ব্যাপারটা গন্ডোগোলের.এক্ষেত্রে অন্য অফিসে যা হয়,উত্তমের অফিসেও তাই শুরু হোল. মাতব্বরেরা দুটো আডাআড়ি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন.শুরু হোল বিতর্ক. একপক্ষ বললেন সব চিঠিগুলো নির্বাচনী দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হোক. আবার নতুন করে চিঠি আসুক. বলাবাহুল্য এনাদের চিঠি এসেছে তুলনামূলক দুর্গম বা অশান্ত জায়গার জন্যে. যাঁরা একটু ভালো জায়গা পেয়েছেন তাঁরা বলতে লাগলেন-কি দরকার সব ফেরত পাঠানোর. মিসেস কালি বলে আমাদের অফিসে কেউ নেই. এটা লিখে মিসেস কালীর চিঠিটাই কেবল ফেরত পাঠানো হোক.বাতবিতন্ডা যুক্তির বন্যায় ভাসছে পুরো অফিসটা. রাজীবদা রাশভারী লোক.কম কথা বলেন. তিনিও থাকতে না পেরে বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেন. বলে বসলেন- আরে আরেকটু ভাবা হোক না. গতবার আমার মিসেস এর নামেও ভোটের চিঠি চলে এসেছিলো. ওদের ব্যাঙ্কে ছজন মহিলা স্টাফ. কারো এল না. আমার গিন্নীর চলে এলো. কেউ কোন কথা শোনে না।বলে চিঠি যখন এসেছে ভোট করতে যেতে হবে। সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। মহিলা বুথ ও ছিল না। মহিলাদের পাঠানো ও হতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শেষে ডি এম অফিসে নাম কাটাতে যেতে হোল। গিয়ে বুঝলাম আসল কারণটা. বাংলায় সুদীপ্তা আর সুদীপ্ত নামের বানান আলাদা হলেও
ইংরেজীতে এক. ওরা  সুদীপ্তাকে সুদীপ্ত মনে করে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে. গিয়ে শুনি আমার আগে আরেকজন  কৃষ্ণা এসে নাম কাটিয়ে গেছে. তাকেও কৃষ্ণ মনে করে ওরা চিঠি পাঠিয়েছিল. অরিত্র আর অরিত্রা নামের ইংরেজি বানান ও তাই। তেমন কোন বিভ্রাট নয় তো এই মিসেস কালী?
উত্তম মন দিয়ে শুনছিল কথাগুলো.কথাটা মন্দ বলেন নি রাজীবদা. এটা হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। তেমন ই কিছু ভুল নয় তো? আচমকাই ওর মাথায় বিদ্যুত্ চমকের মত  একটা ভাবনা ঝলমল করে উঠল. গুটিগুটি পায়ে বড়বাবুর টেবিলের ওপর রাখা চিঠির ওপরে চোখ বোলালো. ঠিক যা ভেবেছে তাই. চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলো  নামের জায়গায় ইংরেজীতে লেখা Mrs Kali. হো হো করে হেসে উঠলো উত্তম. উত্তমের হাসির বহরে ভিড় আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। কি হোল রে
তোর? মাথা খারাপ হোল না কি? অত হাসির কি আছে? ভোটের চিঠি দেখলি না কি শিবরাম চক্কোত্তির লেখা পড়লি?
হাসতে হাসতেই উত্তম বললো- সত্যি তাই মনে হচ্ছে। শিবরাম চক্কতির লেখাই বটে।আর আপনারাও যেমন। দেখবেন তো একটু ভালো করে। ইংরেজী  লেটারগুলো একটু ওলট পালোট করলেই তো আমাদের আলি দা. Mr S k Ali. ওরা টাইপিং এ ভুল করে ওটা Mrs KAli করে ফেলেছে.একটা সমস্বরে হাসির রোল উঠল  পুরো অফিস জুড়ে. আলি দা তো হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়েছেন. সবাই হাহা হিহি হোহো হেহে নিজের মত করে হেসে চলেছেন.
হাসির রোল থামতে বড়বাবু কাতুকুতু ভরা চোখে উত্তমের দিকে তাকিয়ে বললেন-বাবা উত্তম. তোমার মগজটি তো বেশ সরস বাবা. তা যে ধাঁধা পুরো অফিসটাকে ঘোল খাইয়ে  ছেড়ে দিয়েছিল তার সমাধান তোমার মাথায় এত সহজে এল কি করে বাবা? হাসতে হাসতে উত্তম বললো- কথায় বলে না ,কোন শেখা বিদ্যাই বৃথা যায় না.তেমনই  এক ছোটবেলার দুস্টুমী মনে পড়লো. আমাদের পাড়া্য একজন হোমিওপ্যাথিক
ডাক্তার  ছিলেন. বয়স্ক পুরনো ডাক্তার। পাড়ায় সবাই আলম ডাক্তার বলে চিনত।দারুন পেয়ারা হতো ওনার বাড়ির গাছে। আর তাতে যা হয়। পাড়া বেপাড়ার ছেলেদের উতপাত।সবার নজর ওই পেয়ারা গাছের দিকে।তাদের উৎপাত ঠেকাতে আলম কাকা কুকুর পুষতে শুরু করলেন।ছেলে ছোকরা দের উৎপাত এতে বন্ধ হোল। কিন্তু কারো মন মানে না। শেষে একদিন এক বন্ধু আমাকে ধরল। বললও তোদেরই তো পাড়ার কুকুর। তোকে চিনবে নিশ্চয়ই। তাড়া করবে না তোকে। তুই ঢোক। না না করে শেষে একদিন কিছুটা কৌতূহলী হয়ে ব্যাপার টা যাচাই করতে ঢুকলাম  পেয়ারা পাড়তে। উঠেছি গাছে, দূর থেকে কাকা আমায় চিনতে পারেন নি।দেখি উনি কুকুর লেলিয়ে দিয়েছেন. আমি গাছের ওপর। আর সে ব্যাটা কুকুর গাছের তলায় এত বড় জিভ বার করে গজরাচ্ছে।কোথায় চেনাশোনা? যার ভরসায় পেয়ারা পাড়তে আসা। তার হুঙ্কার দেখে মনেই হচ্ছিল না সে আমায় কোনদিন এই পাড়ায় দেখেছে। বাপ রে বাপ। অনেক কষ্টে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচি. রাগে গরগর করতে করতে  মাথায় এক দুস্টু বুদ্ধি এলো.চেম্বারের বাইরের বোর্ডে ওনার নামের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল Dr M.Alam।একদিন সুযোগ বুঝে ব্লেড দিয়ে চেঁছে নামের মাঝখানের ফুলস্টপটা মুছে দিলাম. Dr M.Alam  থেকে হয়ে গেলেন Dr MAlam. যতদিনে ব্যাপারটা ওনার দৃস্টিগোচর বা কর্ণগোচর হয়,ততদিনে পুরো পাড়ায় ওনার নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে মলম  ডাক্তার হিসেবে. বোর্ডে আবার ফুলস্টপ এসে গিয়েছিলো পরে।কিন্তু আজীবন আড়ালে আবডালে উনি ওই মলম ডাক্তার হয়েই রয়ে গেলেন। সেই দুস্টুমিটাই আজকে কাজে লাগালাম. তফাত কেবল, সেদিন  ফুলস্টপটা মুছে দিয়েছিলাম আর আজকে ফুলস্টপ গুলো যথাযোগ্য স্থানে বসালাম.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন