বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

সভ্যতা ও শান্তির সংকট : শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা- আবুল কাইয়ুম


সভ্যতা ও শান্তির সংকট : শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা


সামাজিক ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার অগ্রযাত্রা অনবরত গ্রহণ ও নেতিকরণের প্রক্রিয়ায় মানুষেরই প্রবৃদ্ধি। অন্য কথায়, মানুষ যে বড় হচ্ছে চিন্তায়, মেধায় ও মননে –এই ক্রমবর্ধিষ্ণু সমাজ-সভ্যতা তার প্রতিবিম্ব। মানুষ অশান্তি, অরাজকতা ও বিনষ্টিকে যত ত্যাগ করতে পেরেছে এবং শান্তি, সুখ ও কল্যাণকে যত আঁকড়ে ধরেছে ততই পরিশুদ্ধ হয়েছে মানব সভ্যতা।  সমাজ-সভ্যতার প্রবৃদ্ধি প্রযুক্তিনির্ভর তো বটেই, তবে তা জীবনঘনিষ্ঠ কর্মকাণ্ড নিয়েই বিকশিত হয়, জীবনবিমুখতা তার হন্তারক। সমাজের উপাদান যেমন মানুষ, সমাজের লক্ষ্যও মানুষের জাগতিক উন্নতি বিধান করা। মানুষই এখানে চূড়ান্ত, মানুষের উন্নয়নই সমাজ-উন্নয়নের মাপকাঠি। ম্যাক্সিম গোর্কি একবার লেভ তলস্তয়কে লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে মহোত্তর কিছু নেই, --- মানুষই একমাত্র বাস্তব সত্য”।  মানুষের বাঁচার তাগিদ প্রবল বলেই সে কিছু আবশ্যক হিতকর নীতির সাথে আপস করতে চায়, সর্বদা চেয়েছেও। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে সহায়ক এ সব অভিজ্ঞতালব্ধ আদর্শিক সূত্রাবলী মানুষই উদ্ভাবন করেছে। বেঁচে থাকার জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবকল্যাণ ও সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে যে সব কর্ম ও ধারণা কাজে এসেছে তাই গ্রহণ করেছে মানুষ। সে সাথে সে বর্জন করতে চেয়েছে অকল্যাণ ও অহিতকে, কুৎসিৎ ও মন্দকে। ভালোমন্দ বাছাইয়ের এই ক্ষমতা আছে বলেই সে শ্রেষ্ঠ, মেধাবী ও মননশীল। মানুষ জেনেছে, বাস্তব জ্ঞান প্রায়োগিক সফলতা থেকেই বিকশিত হয়। সে দেখেছে, ধান ভূমিতে জন্মে, আকাশে নয়। এর জন্য আবশ্যক জমিকর্ষণ, বীজবপন, সেচ, সার ও প্রতিকূল আবহাওয়ায় শস্য রক্ষার কৌশল, অর্থাৎ একটি বিশেষ পদ্ধতি। হাজার হাজার বছরের সাধনায় মানুষ এ ধান বোনার পদ্ধতিটি শিখেছে, আবার হাজারো বছরের অভিজ্ঞতায় মানুষ চাষাবাদের প্রক্রিয়াকে আধুনিক করতে পেরেছে। এসব অর্জিত জ্ঞান ও কৌশলকে সে অস্বীকার করে না। এ ছাড়া ফসল উৎপাদনের কোন পন্থা মানুষের জানা নেই। সে জেনেছে, এই পদ্ধতিকে অস্বীকার করার নিশ্চিত পরিণতি অপমৃত্যু।  শুরুতে মানুষ ছিল আদিম, বর্বর, হিংস্র ও অসভ্য। তার আত্মবোধ জন্মেছিল বলেই সে মানবসংহারী নৈরাজ্য দূর করতে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল নিজেদের মাঝে। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে কোন সার্বভৌম বা ‘সাধারণ ইচ্ছে’র কাছে কুর্নিশ জানিয়েও সেই বর্বরতাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারেনি মানুষ। তবু একটি নিয়মের কাছে সমর্পিত হয়ে সে সভ্য ও সামাজিক হয়ে উঠেছে।  মানুষ শান্তি ও মঙ্গলের জন্য সমাজ গঠন করলেও তার শান্তিতে নানা আকারে-প্রকারে হুমকি ও বিনষ্টি এসেছে বার বার, অসংখ্য অসংখ্য বার। আর তা সময়ের সাথে তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছে। আজকের ভীতি পাথুরে বল্লম নয়, ক্রুশকাঠ কিংবা গিলোটিন নয়, এমনকি চেঙ্গিস বা নেপোলিয়নের মতো দুর্ধর্ষ খুনি সেনাপতিও নয়। আজকের প্রধান ভীতি বিভিন্ন পরাশক্তি ও  তাদের দোসরদের হাতে মওজুত লক্ষকোটি আধুনিক সমরাস্ত্র, হাজারো পরমাণু বোমা ও রাসায়নিক বোমা।  আদিকালে মানুষ সাধারণত পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতো  ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য পশু শিকারে এবং হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায়। আর আজকের কতিপয় যুদ্ধবাজ মানুষ তৈরি করছে যত আধুনিক সমরাস্ত্র মানব জাতিকেই ধ্বংসের জন্য এবং ধ্বংস করে চলছেও। শুধু জীবনকে নিয়ে নয়, যুদ্ধ যেন আজ সারা বিশ্বকে নিয়ে এক মর্মান্তিক হোলিখেলায় মেতেছে। হিটলার পিঁপড়ের মতো টিপে টিপে হত্যা করেছিল মানব সন্তানকে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যন্ত্রণা দিয়ে কিংবা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করতে, বোমা মেরে শহর নিশ্চিহ্ন করতে ও জনপদ উড়িয়ে দিতে তার বাঁধেনি। সেই হিটলার আজ ভূত হয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীর বুকে। হিরোসিমা ও নাগাসাগিতে তাৎক্ষণিক ও বংশানুক্রমিকভাবে লাখ লাখ জীবন নিয়েও এদের সাধ মেটেনি। শুধু আমাদের বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতেই নয়, কোরিয়া, হাঙ্গেরি, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরাক সহ বিশ্বের অনেক জনপদ রঞ্জিত হয়েছে কোটি মানুষের রক্তে। আজ পৃথিবীর মানুষের প্রধান উদ্বেগ, এ নরবলির কী শেষ নেই! দেশে দেশে সংঘটিত নিপীড়ন, দমন আর হত্যার পরিণাম কী হবে! আর কতো দিন চলবে নিরীহের উপর অত্যাচারীর, দুর্বলের উপর সবলের, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের রক্ত থাবা!  আমরা দেখেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে ততই বিশ্বময় যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের ধারণা ছিল, মানব সভ্যতা হয়তো অমর। কিন্তু আজ যুদ্ধবাজদের রণহুঙ্কার ও দুষ্কর্মের মুখোমুখি হয়ে আমাদের সে বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ আধুনিক রণ-উন্মত্ততা আদিম বর্বরতার চেয়েও কুৎসিৎ। একে সভ্যতা বলা চলে না, এ এক জঘন্য উল্টোযাত্রা, আদিমতার চরমে প্রত্যাগমনের পাঁয়তারা। বিশ্বের কয়েক’শ কোটি মানুষ এই মহা-আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে আজ সোচ্চার। প্রচণ্ড ঘৃণায় তারা এই যুদ্ধ আর সভ্যতা-বিধ্বংসী পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংস কামনা করছে। আমরা দেখেছি আদিম, মধ্যযুগীয় বা আধুনিক –কোন অত্যাচার বা যুদ্ধকেই মানুষ মেনে নেয়নি, সে চির প্রতিবাদী। সহস্র বছরের ধ্বংস ও হননের শিকার হয়ে মানুষের চেতনায় সেঁটে গেছে এ চিন্ময়তা, এ সংগ্রামী আত্মবোধ।  যুদ্ধ সব সময় সুবিধে কাড়ে এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এক মানুষের উপর অন্য মানুষের, এক জাতির উপর অন্য জাতির। যুদ্ধ সব সময় নিষ্পেষণ করে, বিভেদ সৃষ্টি করে এবং ধ্বংস করে। কিন্তু শান্তি চায় সমতা, শান্তির মানেই হলো সহনশীলতা, একে অপরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার সহ্যশক্তি। মানবতা. সততা, সংহতি, স্বাধীনতা ও প্রগতির নিরুপদ্রব মহৎ অবস্থাটির নামই শান্তি। যুদ্ধ মানুষ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করে, কিন্তু শান্তি মানুষের সমাজ ও সভ্যতাকে নির্মাণ ও অগ্রগামী করে। এই গ্রহের একমাত্র প্রত্যাশাই আজ শান্তি। এ ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় পন্থা নেই। 
যুদ্ধবাজ ও অশান্তির হোতাদের ধর্ম হলো প্রতিনিয়ত বাস্তবতাকে, সত্য ও ন্যায়কে অস্বীকার করা। অন্যায়কারী বা অপরাধীর কোন হিতজ্ঞান নেই, মানুষের জীবন তার কাছে মূল্যহীন। কিন্তু মানুষকে যে ভালোবাসে সে কখনো তার ক্ষতি করে না, বরং তাকে কাছে টানে, যূথবদ্ধ হয় সমাজ নির্মাণে। শান্তি আরাধ্য বলেই প্রগতি তার লক্ষ্য, সুন্দর তার সাধনা। সে অন্তরে সর্বদা লালন করে প্রেমময় সত্তা। প্রকৃত মানুষ মানুষেরই কথা বলে, মানবকল্যাণে কাজ করে এবং মানুষের হিত কামনায় ছবি আঁকে, গান গায়, সাহিত্য গড়ে। লোলুপ ও সংকীর্ণ ইচ্ছেকে অবদমন করে বিশ্বশান্তি ও সমাজ গঠনের অদম্য আর্তনাদ ছড়ায় সে তার কবিতা, সাহিত্য ও শিল্পে। সকল আস্ফালন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে বনে গেছে প্রগতির তরিৎকর্মা সৈনিক। মানুষের প্রধান লক্ষ্য যে শান্তি তাই আজ শিল্পসাহিত্যে মুখ্য উপজীব্য হয়েছে বিশ্বময়। বর্বরতা ও নৃশংসতার এ যুগে শিল্পসাহিত্য মানুষকে মানবতার পক্ষে একত্রিত করেছে। এই পৃথিবীতে একটিই অস্ত্র থাকা উচিত, -তা হলো লেখকের কলম। এ কলমই শান্তির অমিয় বাণী ঝরাবে, আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমিত করবে এবং মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্ব ও সমঝোতা এনে দেবে।  সভ্যতা সংরক্ষণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীকে অস্ত্রমুক্ত করার বিষয়টি এড়িয়ে নিছক স্বকপোলকল্পিত রূপকথা নির্মাণ বা আকাশচারিতায় মগ্ন থাকা এ যুগের শিল্পী-সাহিত্যিকদের উচিত নয়। ভবিষৎ পৃথিবীর অস্তিত্ব ও আগামি দিনের বংশধরদের জীবনের অনিশ্চয়তাকে জিইয়ে রেখে উদ্ভট ইউটোপিয়া নির্মাণের ধ্যানের মাঝে যে সকল লেখক নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন তাঁরা প্রকারান্তরে ঘাতক দলেরই সেবক। স্বার্থ ও কাল্পনিকতার ধূম্রবলয় থেকে তাঁদেরকে মুক্তি পেতে হবে। মানবহিতৈষণাই হওয়া উচিত তাঁদের মিশন। জাতীয়-সামাজিক ও গোষ্ঠীগত অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানব-বিবেক জাগ্রত রাখার দায়িত্ব শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও। মানুষের স্বাধীনতা ও সুখের দিশা তাঁরাই দেবেন। তাঁরাই আনবেন পূর্ণ ও স্থায়ী শান্তির সূর্যকে ছিনিয়ে।  শিল্পীর কল্পনা বাস্তব জীবনকে ঘিরে ও মানবকল্যাণকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা উচিত। বস্তুনিষ্ঠ কল্পনা থাকবে, কিন্তু নিছক কল্পনাবিলাসী হওয়া তার জন্য পাপ। আমার মতে, শিল্পসাহিত্যের সম্ভোগে মানুষের চিত্তে জাগরিত আনন্দময়তার কারণ আর কিছু নয়, সে মানবিকতা। এ আনন্দও অতিলৌকিক কিছু নয়, এ হলো মানব-মনে ভালোবাসার উদ্রেক। মানুষের এ ভালোবাসা কখনো অশান্তি, অনাচার ও অপ্রয়োজনীয় আবর্জনাকে আশ্লেষ করে না। মানুষ ভালোবাসবে মানুষকে, মানুষের শান্তি ও কল্যাণকে। বিশ্বশান্তি, মানুষের স্বাধীনতা ও আত্মবিকাশের পথটি ছেড়ে নিষ্ফলা কল্পনাবিলাসের সাথে শিল্পীসাহিত্যিকদের, এমনকি কোন মানুষেরই সখ্য গড়ে উঠতে পারে না। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন