শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭

পাপের ফসল (গল্প) - এস আই জীবন

পাপের ফসল

               গল্প

 যে মেয়েটি সব চেয়ে বেশী বিলাসিতায় নিজেকে পরিপাটি করে রাখতো। প্রতিদিন হালাল পরিশ্রমের পরে মটরসাইকেল নিয়ে হারামের লোভে ছুটে বেড়াতো পাখির মতো। সে'ই একদিন রাতে লোক লজ্জার ভয়ে কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো ৭ মাসের পাপের ফসল পেটে ধারণ করে।
    নব দাম্পত্যজীবন শুরু করে একটি ফুটফূটে শিশুর জন্ম দিয়ে, আরো একটু ভালো ভাবে জীবনযাপন করতে যে মহিলাটি স্বামী সহ প্রবাসী হয়েছিলো, সেই মহিলাটিও এক বছরের শিশু রেখে অন্যের হাত ধরে স্বামী রেখে পালিয়ে গিয়েছিলো।
     যে মহিলাটিকে সব চেয়ে বেশী ভদ্র নম্র মনে হতো, পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তো। সেও রাতের অন্ধকারে মাত্র ৫০ রিঙ্গিতের বিনিময়ে দেহ বিক্রি করতো।
     যে মহিলাকে দেখেছি নিজেকে নিয়ে আত্ম অহংকার করতে, তিনি নিজেই বলে বেড়াতো লক্ষ টাকা দিলেও সে অবৈধ কাজ করবেনা। সেই মহিলাই এক বছর না যেতেই দু জন অবৈধ শিশুর জন্ম দিলো।
     এখানে যে কয়টি নারীর কথা বলেছি, তারা প্রত্যেকেই ইন্দোনেশিয়ান নারী। আমাদের কম্পানিতে প্রায় ২০/২৫ জন নারী শ্রমিক আছে।  এরা সকলেই ইন্দোনেশিয়ান। ইন্ডিয়ান কিছু মহিলা শ্রমিক ছিলো,  তারা অনেক আগেই এ কম্পানি থেকে পালিয়ে চলে গেছেন।

    সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রতিদিনের মতো প্রাকৃতিক কর্ম সেরে অফিশে যেতেই হাফ লেডিস বেশ উজ্জ্বল আর বারতি আনন্দে আটখান হয়ে বললো।
    আজ ইন্ডিয়ান ৫ জন নারী কর্মী আসবে।
    কিছুটা বিরক্তির সাথেই বললাম,
    আসলে তাতে আমার কি!
    এ কম্পানিতে ইন্ডিয়ান মহিলা এই প্রথম, তাই সংবাদটা তোকে দিলাম।
     এতো লোক থাকতে আমাকে দিলি কেনো।
     তোর পাশের রুম খালি করা হয়েছে। ঐ রুমেই তারা থাকবে।
     ও.... তাই...! তো তারা কখন আসবেন?
     আজ রাতেই।
     বেশ তো, আসুক; বলেই আমি আমার হাজিরার কার্ড মেশিনে পাঞ্চ করে গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেলাম। কারা আসে কারা যায় এ নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই, এ কম্পানিতে কতো লোক আসলো আর কত লোক গেলো তার ইয়ত্তা নেই। রাতে এসে সকালেই পালিয়ে যায়, এমনও তো স্বচক্ষে দেখেছি। আবার কেউ কেউ এসে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে, বলেছে খরচ টাকা তুলেই চলে যাবে আর বিদেশ থাকবে না,  অথচ তারাই কেউ কেউ একটানা ৫ বছরেও দেশের যাওয়ার কথা একবার মনেও করেনা। প্রবাসীর মনের পরিবর্তন হয় প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে। এখানে কেউ বাঁধা নয়, সকলেই মুক্তচিন্তার পাখি।   আবার কেউ কেউ থেকে যায়া বছরের পর বছর আকাশ ছোঁয়া লক্ষ্য নিয়ে।

     ঘন্টা দুয়েক বাদে আমাদের কম্পানীর ইন্ডিয়ান ইনচার্জ মানিকাম বস্ আসলেন আমার কর্মস্থালে। কাজের ফাঁকে ফেইসবুকে চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন। কম্পানীর যে প্রজেক্টে আমি কাজের তদারকি করি, এ প্রজেক্ট কম্পানির এড়িয়ার শেষ প্রান্ত,  তাই বিশেষ দরকার ছাড়া এখানে কোনো ম্যানেজার বা কেরানী আসেন না। সেই সুবাদে আমি যখন তখন ফেইসবুকে ঢু মারতে পারি।
মানিকাম বসকে দেখেই আমি তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা অফ করে পকেটে রেখে দিলাম। বস আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। আমি জানি আমার হাতে মোবাইল দেখলেও তিনি রাগ হবেন না,  তবুও তার সম্মানার্থেই আমার এ ভক্তি শ্রদ্ধা তারপ্রতি। মানুষের মনে জায়গা করে নিতে হলে তাকে সকল দিকে বিবেকবান হতে হবে। নম্রতা আর ভদ্রতার বিকল্প নাই।  কৌশলের ঔষধ বেশী কার্যকরী।  যাই হোক।
বস এসে বলে গেলেন, রাতে ইন্ডিয়ান মহিলা কর্মী আসবে ৫ জন। তাদের দেখাশোনা করতে। যেহেতু তারা নতুন। আমি জানিনা তারা আমার ভাষা বুঝবেন কি না। বসের মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাদের নিরাপত্তা।  কোনো ছেলে কর্মী যেনো বিরক্ত না করতে পারে। বসের এমন কথা শুনে বুঝলাম নিজের দেশের মানুষের প্রতি এটা তার বাড়তি ভালোবাসা বা টান। এমনটা সকলের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। টান থাকবেই বা না কেনো। রক্তের প্রতি রক্তের টান আর স্বদেশের মানুষের প্রতি বারতি ভালোবাসা সকলেরই থাকে। এটাও দেশপ্রেমের একটা অংশ।
    সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্ত শরীর নিয়ে একাকী সংসারের আপন কর্ম সম্পন্ন করে পেটের জামিন শেষে কখন বিছানায় হেলে পরেছিলাম ঠিক স্মরণ ছিলোনা। ঘড়ির কাটা তখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিলো সেদিকেও তাকানো হয়নি। প্রবাসে এসে গ্রাম্য পরিবেশের মাঝে কাজ করলে কি হবে, পশ্চিমে হেলে পরা সূর্যের অপরূপ সৌন্দর্যময়তা তেমন কখনোই দেখার গভীর আগ্রহ হতোনা। ডিউটি থেকে ফিরে অফিশে হাজিরা দিয়ে বাসায় এসে গোসল করতে করতে মসজিদে আজান হয়।  নামাজ শেষে রান্না করা খাওয়াদাওয়া করা কখন রাত ৯ টা বেজে যায় তা টের পাওয়া যায়না। প্রতিরাতের একই নিয়ম রাত ১০ টা বাজলেই বিছানার সাথে যুক্ত হওয়া। যখন বস্ আমাকে ঢেকে কাঁচা নিদ্রা থেকে জাগালেন। তখন অনেকটা বিরক্তি এসে জট পাকাচ্ছিলো, ঘড়ির মিনিটের কাটা ১২:৩০ ছুঁইছুঁই। অন্য সকল কর্মীরা তখন ঘুমের সাগরে তলিয়ে আছে। চোখে ঘুমের বিভোর আসক্তি থাকা সত্যেও দরজা খুলে দিলাম।  দরজা খুলে দেখি বসের সাথে শ্যামলা বর্ণের চারজন মহিলা আর একজন মহিলা বেশ ফর্সা। সকলের বয়েস ত্রিশ অতিক্রম করেছে। ফর্সা মহিলা চল্লিশ পার হবে হয়ত। সকলের ব্যাগের সাথেই প্লেনের সিকিউরিটি কাগজ তখনো ঝুলছিলো। তাদের তিকে তাকিয়ে দেখলাম তাদের পরিধেয় অনেকটা বাঙ্গালিয়ানা। হাসিমুখে মালায়ু ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম, আপা কাবার?  ( আপনারা কেমন আছেন) কোনো প্রতি উত্তর আসলোনা, বুঝতে সক্ষম হলাম তারা আমার কথা বুঝতে পারেনি। হাউ আর ইউ বলতেই ফর্সা মহিলা হাসি মুখে বললো, আলহামদুলিল্লাহ্‌। বস্ আমাকে বললো, তারা মালাইয়ু ভাষা জানেনা। বস্ তামিল ভাষায় কি যেনো বলছিলেন তাদের সাথে আমি ঠিক বুঝতে সক্ষম হয়নি, তবে তার কথার মাঝে বেশ কয়েকবার আমার নাম উচ্চারণ করায় বুঝলাম আমার সম্পর্কেই বলেছেন। বস্ আমার সাথে মালাই ভাষায় কথা বলেন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম তামিল ভাষা শেখার জন্য কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।

     আমাদের হাফ লেডিস অফিস থেকে পাঁচটি রেডিমেড বেড আর বালিশ এনে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষের ভিতরে রাখলো। হাফ লেডিস বলার কারণ,  এই লোকটা পুরুষ হলেও তার চাল চলন কাজকর্ম মহিলাদের মতো। মাঝেমধ্যে সে ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগায়, পরচুল লাগিয়ে নারী সাজতে নাকি তার ভালো লাগে। এমনটা তার জিনগত সমস্যা নাকি অন্য কোনো কারণে তা আমার জানা নেই। দুই সন্তান সহ সুন্দরী রমণী নিয়ে অনেক সুখের পরিবার তার। অনেক ফ্রেশ মনের মানুষ,
    এই লোকটার মনের মাঝে কোনো হিংসা অহংকার নাই। অনেটাই সরল মনের মানুষ।  তার আচার আচরণ মহিলাদের মতো। এ কম্পানির সকলে তাকে হিজলা উপাধি দিয়েছে। শব্দটা বেশ অরুচিকর তাই আমি তাকে হাফ লেডিস বলে সম্বোধন করি। এতে তার মাঝে কখনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাইনি, সে এমন ঠাট্টা ইয়ার্কি সব সময় হাসিমুখে মেনে নিয়ে সকলের সাথেই সমান আচরণ করে। মাঝে মাঝে সুদর্শন পুরুষ দেখলেই বলে, মেয়ে হলে এমন একটি ছেলেকে সে বিয়ে করতো।

     মানিকাম বস্ তাদের একজনের হাতে কক্ষের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে,  আমাকে বলে গেলেন তাদের কোনো কিছুর দরকার হলে যেনো সহযোগিতা করি। আমার মুখের দিকে বেশ কয়েকবার মায়ের বয়সী ফর্সা মহিলাটি যেনো অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার দিকে তার ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকাটা অনেকটা বিরক্তিকর লাগছিলো। কিন্তু তার ঠোঁটে মায়াময় হাসি লেগেই ছিলো। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
    এখানে কতবছর যাবত কাজ করো তুমি?
    আমি যেনো আকাশ থেকে পরলাম। তামিল মহিলা বাংলা ভাষা জানে!
    আমি বললাম
    ৭ বছর ধরে এ কম্পানিতে কাজ করে আসছি। একটু থেমে তাকে আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলাম।
    আপনি বাংলা জানেন!
    এক ঝলক হাসি বিছিয়ে বললেন; হ্যাঁ আমি সৌদিআরব ৫ বছর ছিলাম। ওখানের অনেক বাঙ্গালীদের সাথে ওঠাবসা ছিলো আমার। তাদের কাছ থেকে শিখেছি।
    কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
    আমি তাকে নিশ্চিত করে বললাম
    আপনাদের কোনোকিছুর দরকার হলে আমাকে জানাবেন।
    আমি তাদেরকে রান্নাঘর গোসলখানা সব দেখিয়ে দিয়ে তাদের জন্য রান্নার গ্যাসের লাইন ঠিক করে দিলাম।
    আমি আর হাফলেডিস নাসির দুজনে মিলে তাদের রুমটা আরো একবার ঝাড়ু দিয়ে বাদে তাদের বেড গুলো পেতে দিলাম। তারাও সহযোগিতা করেছিলো। দেশ থেকে নিয়ে আসা হরেক রকমের খাবার বের করে আমাদের সামনে দিলো, যাই হোক আমরা আর কি আপ্যায়ন করবো। আমরা দুজনেই আপ্যায়িত হলাম তাদের নিকট।
    তাদের পাঁচ জনের মধ্যে ফর্সা মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি মুসলিম?
     হ্যাঁ, আপনি?
     আমিও মুসলিম,  আমার সাথের তারা চারজন হিন্দু।
     আপনাদের একসাথে থাকতে সমস্যা হবেনা?
    না তা হবেনা। আমরা সকলেই একই গ্রামের মানুষ। আর আরব দেশেও বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকার অভ্যাস আছে আমার। এখানে আমরা নতুন এসেছি,  এখন একসাথেই থাকি তারপর যে যার সময় মতো আমরা আমাদের মতো থাকবো। আমাদের দুজনের দিকে অন্য চারজন মহিলা শুধু হা করে তাকিয়ে থাকতো আর আর শুনতো আমরা কি বলি। তারা আমাদের কথা বুঝতোনা।
    রাতের গভীরতা বাড়ছে, ঘুমে আমার চোখ বুজে আসছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম,  অনেক রাত হলো, আর আপনারা অনেক জার্নি করে এসেছেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।

    দুই দিন বাদে তাদেরকে সার দেয়ার কাজ দেয়া হলো। ম্যানেজার আমাকে বললো তাদের কাজ দেখাশোনা করতে। সকাল সাতটায়, ১০০ বস্তা সার লোড করা হয়েছে একটি লরিতে, তারা ৫ জন আমি আর ড্রাইভার।  সকাল বেলা তারা খুব দ্রুত কাজ করতেছিলো। দুপুর ১২টার পরে সকলেই দুর্বল হয়ে পরলো সূর্যের তাপ লাগা লাউয়ের ডগার মতো।  বয়স্ক মহলাটি কচু শাকের মতো নেতিয়ে গেছে। তার চোখে জল টলমল করছে। আমি বুঝতে পারলাম। আমি আর ড্রাইভার না থাকলে কেঁদেই ফেলতো। বুঝেও না বুঝার ভান করলাম আমি। মহিলাটির মুখের দিকে তাকালে খুব মায়া লাগে। মায়ের বয়সী মহিলা। এ কেমন হাল হয়েছে তার।

     আমি চোখ গরম দিয়ে বললাম এটা আরব দেশ নয় এটা মালয়েশিয়া।  এখানে এক টাকা আয় করতে ১০ টাকার রক্ত জল করতে হয়। মহিলাটি কিছু না বলে চুপচাপ কাঁধের বালতি বোঝাই করে সার নিয়ে ছিটানোর জন্য চলে গেলো। অন্য সব মহিলারা আমার ভয়ে খুব দ্রুতই কাজ করতেছিলো। এটুকু বুঝলাম অন্য চারজন দেশে থাকতে তারা মাঠে কাজ করেছে। তাই তারা তেমন ক্লান্ত বোধ করেনি।
    আমি বয়স্ক মহিলাকেই বেশী ফলো করছিলাম। তাকিয়ে দেখলাম সে পাম গাছের আড়ালে বালতি রেখে অঝরে কাঁদছেন। আমার খুব মায়া হলো। তার কাঁধ থেকে বালতিটা আমি নিয়ে তাকে বললাম বিশ্রাম নিতে। সে ভেবেছিলো আমি তার প্রতি বেশী রাগ হয়েছি। কর্মস্থলে কারোপ্রতি দরদ দেখানো বিপদজনক। আমার রাগের কারণ তারা বুঝবেনা। আমি দায়ীত্বে বন্দি, লোক দিয়ে কাজ না করালে উপর থেকে তিতা কথা শুনতে হয়। ওয়ার্কারের সাথে আমরা রাগ দেখাই ঠিকই কিন্তু তা লোকদেখানো মাত্র। আর এটা তারাও বুঝে তাই আমরা কেউ কখনো এসব মনে রাখিনা।
     তার ভাগের প্রায় ১৫ বস্তা সার আমি ছিটিয়ে দিলাম।
তিনি যে কত খুশি হয়েছেন তা লিখে বলে বুঝানো যাবেনা। এভাবে প্রায় প্রতিদিন তার কাজে যোগান দিতাম। তার মুখের দিকে তাকালেই আমার মায়ের মুখ ভেসে উঠতো। ঐ মহিলাকে নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলতো আমার পিছনে, কিন্তু আমার সামনে বলার কেউ সাহস করতোনা। একমাস না যেতেই অন্য চারজন মহিলা তাদের খুশি মতো বিকেলে রাতে বাইরে বেড়িয়ে যেতো। এই বয়স্কা মহিলা কাজ শেষে কোথাও বের হতোনা। আমি একদিন তাকে বললাম। সকলেই সন্ধ্যার পরে হারিয়ে যায়,  আপনি কেনো বাসায় বসে থাকেন। তিনি শান্ত ভাবেই হেসে জবাব দিলেন।
     জীবন, হারামে বরকত নাই। অনেক বড় ভুল করেছিলাম জীবনে,
     ঠিক বলেছেন আপনি। কি ভুল করেছিলেন?
      অন্য একদিন বলবো, আমার দুটো মেয়ে আছে দেখবা?
      দেখার আগ্রহ জানিয়ে বললাম, হ্যাঁ দেখান।
তিনি তার মোবাইলে তোলা দুটো মেয়ের ছবি দেখালেন, বড় মেয়েটি তার মতোই ফর্সা আর অনেক সুন্দর। ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম। এই মেয়ে তো বাঙ্গালী মেয়েদের মতো নয়। তিনি কিছুটা মলিন হয়ে গেলেন। মেঘ জমা হলো তার চোখে মুখে। তিনি ধীর ভাবেই উত্তর দিলেন। ওদের দেশের পুরুষ গুলো মোটেই ভালোনা।
   মেয়েটার মুখের গঠন ঠিক আরবিয়াদের মতো।
    আমার মুখের দিকে বার কয়েক তাকিয়ে বললো রক্তই বলে দেয় কে কোথার মানুষ।  ঠিক বুঝে নিতে কিছুক্ষণ লাগলো আমার।
    আরো বেশ কিছু ছবি রয়েছে তার মোবাইলের গ্যালারিতে। অকারণেই চোখ বুলালাম আরো কিছু ছবির দিকে। জিজ্ঞেস করলাম।
    আপনার স্বামীর ছবি নাই।
    তিনি হয়ত এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন তা হয়ত ভাবেন নি। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বাদে বললেন। আছে হয়ত।
     এই হয়ত শব্দটি আমার কাছে মনে হলো তার স্বামীর সাথে ভালো সম্পর্ক নাই। আর থাকবেই বা কেমন করে।  স্ত্রী যদি অবৈধ সন্তান পেটে ধারণ করে দেশে ফিরে আসে। তাহলে প্রত্যেক সামীর বুকেই পাহারের মতো কষ্টে এসে চাপ প্রয়োগ করে।
      তিনি নিজেই খুঁজে একজন পুরুষের ছবি দেখালেন। মনে হলো প্যারালাইজডের রোগী। এক হাতে লাঠিভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি অসুস্থ?
     উত্তর দিলো, তার এক অংশ নিস্তেজ।  জ্বর হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে। অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেনি। প্রবাসে গিয়ে অনেক টাকা পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন কিন্তু অসময়ে চিকিৎসায় তেমন ফল হয়নি। তবে আগে তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। উন্নত চিকিৎসার কারণে এখন তিনি লাঠি ভর করে চলতে পারেন। তিনি ছোট মেয়েটির ছবি দেখিয়ে আবার বললেন তার জীবনের নিরেট সত্য। সৌদিআরব থেকে দেশে ফেরার দুই মাস বাদে তার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় এই মেয়েটি। মালিকের অবিবাহিত ছেলের প্রতিনিয়ত জোরপূর্বক ধর্ষণের ফল এই মেয়েটি। আমি পাপ করেছি কিন্তু এই শিশু ওর কি পাপ ছিলো। ও তো নিষ্পাপ। এই মেয়েটি জন্মানোর সাথে সাথেই বুঝেছি জাহান্নামের চেয়েও ভয়াবহ হয় মানুষের ঘৃণা আরর অবহেলা। আমি বেঁচে আছি না কি মরে আছি এই দুনিয়ার মাঝে তাই মাঝেমধ্যে বুঝতে কষ্ট হয় আমার। গ্রামবাসী আর সমাজ, আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। অন্য গ্রামে গিয়ে আপন পরিচয় গোপন করে মরার মতো বেঁচে আছি আজো।

    আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। সমাজে সব চেয়ে ঘৃণ্য মানুষ আমি। এ সমাজে সব দোষের বোঝা নারীর উপরে। আমার উপরে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সকল অপরাধ। তবুও মাথা পেতে সব সয়ে যাই। আমি যে একজন নারী। নারী হয়ে জন্মানোই যেনো মহাপাপ এই সমাজে। মাঝখান থেকে কেটে ফেলা কলাগাছ আমি। আমার জীবন অন্ধকার। নষ্ট যা হবার হয়েছি আর নয়।
      আমি নষ্ট হলে ওরাও একদিন নষ্ট হয়ে যাবে, আমি কখনোই চাইনা আমার সন্তানরা নষ্ট হোক।
      তার কথাগুলো শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলাম আমি।
      তিনি সকলের উদ্দেশ্যে একটা ম্যাসেজ দিলেন। নারী কর্মীদের জন্য আরব দেশগুলো অনিরাপদ। কোনো নারী কর্মী যেনো আরব দেশে না যায়।

     আমি বাজারে গেলেই এই মহিলার কথা মনে হতো। তিনিও বাজারে যেতেন। তিনি বাজারে গেলেই আমার জন্য কিছু না কিছু খাবার কিনে নিয়ে আসতেন। আমি প্রায়ই বলতাম। আপনার বেতন অতি সামান্য। আপনি কেনো আমার জন্য বাজার থেকে এটাসেটা কিনে আনেন। আমি তারজন্য প্রায়ই আপেল কমলা কিনে নিয়ে এসে দিতাম। বলতাম বেশী বেশী ফল খাবেন গায়ে বল হবে কাজ করতে ক্লান্তি কম আসবে। এভাবে কেটে গেলো বছর দুয়েক। একদিন রাত্র তিনটার দিকে আমায় ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। আমি দুয়ার খুলেই দেখলাম তিনি। অশ্রুজলে ভাসছে তার চোখের পাতা। ভাবলাম রাতে কেউ বিরক্ত করেছে হয়ত। জিজ্ঞেস করলাম,
    আনটি এতো রাতে!  কি হয়েছে।
    চোখের জল মুছতে মুছতে বললো।
     আমার বান্ধবী থাকে জহুর বারু। ওর খোজ পেয়েছি। আমাকে নিতে এসেছে।  আমি চলে যাচ্ছি, সাবধানে থেকো বাবা। মানিব্যাগ খুঁজে একশত রিঙ্গিত হবে হয়ত, তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম। কিছু কিনে খাবেন। আর সমস্যা হলে মোবাইলে যোগাযোগ করবেন।
    তিনি সেই রাতে যে চলে গিয়েছেন আর আজো তার খোজ পাইনি। হয়ত ভালো আছেন তিনি। দোয়া করি তিনি ভালো থাকুন। আল্লাহ্‌ তাকে নিরাপদে রাখুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন